শিরোনাম
নয় বছর আগে, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার অদূরে, সাভারের রানা প্লাজায় ঘটে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। আটতলা বিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন, যেটিতে অবৈধভাবে কারখানা স্থাপন করা হয়েছিল সেটি ধসে পড়ে। নিহত হন এক হাজার ১৩৪ জন। আহত হন আরও দুই হাজারের বেশি। তাদের সবাই ছিলেন পোশাকশ্রমিক। এ ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনে দুটি মামলা হয়। এর কোনোটিরই তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হলেও অন্য মামলায় রয়েছে স্থগিতাদেশ।
মামলার কার্যক্রমে বিলম্ব হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ দায় চাপিয়েছে আসামিপক্ষের ওপর। তবে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, রাষ্ট্রপক্ষের উচিত দ্রুত স্থগিতাদেশ নিষ্পত্তি করে মামলার কার্যক্রম চালু করা।
প্রায় ছয় বছর আগে এই দুই মামলার অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য করেন বিচারিক আদালত। অভিযোগ গঠনের প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। অন্যদিকে একই ঘটনায় দায়ের করা ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে। মামলা স্থগিত থাকায় অভিযোগ গঠনের ছয় বছরেও শুরু হয়নি সাক্ষ্যগ্রহণ।
আদালত সূত্র জানায়, হত্যা মামলায় অভিযোগ গঠনের পর এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যান আট আসামি। এদের মধ্যে সাতজনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়। মামলার আরেক আসামি সাভার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলীর পক্ষে করা আবেদনে মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি মামলার বাদী সাভার থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ আদালতে সাক্ষ্য দেন। ১৬ এপ্রিল তার সাক্ষের ওপর জেরা শেষ করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। আগামী ২৯ মে মামলাটির পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
অন্যদিকে ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতে কয়েকজন আসামি রিভিশন আবেদন করেন। এদের মধ্যে আসামি ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামকে মামলাটি থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। এছাড়া মামলার আরেক আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাতউল্লাহর পক্ষে গত ৭ নভেম্বর এক বছরের জন্য মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালতে এ মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত থাকায় অভিযোগ গঠনের ছয় বছর পরও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
হত্যা মামলার বিষয়ে ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি বিমল সমদ্দার বলেন, অভিযোগ গঠনের পর আটজন আসামি উচ্চ আদালতে গিয়ে মামলাটি স্থগিতের আবেদন করেন। তাদের মধ্যে সাতজনের আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। মামলার আসামি সাভার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলীর পক্ষে মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম এখনো স্থগিত রয়েছে। অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে গত ৩১ জানুয়ারি মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবীরা মামলার বিচারিক কার্যক্রম বিলম্বিত করছেন। আমরা আলোচিত মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি। আশা করছি মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম দ্রুত শেষ করা যাবে।
ইমারত নির্মাণ আইনের মামলা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আনোয়ারুল কবির বাবুল বলেন, কয়েকজন আসামি অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন আবেদন করেন। তাদের মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ ও সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন আদালত। অন্যদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ মামলার আসামি সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাতউল্লাহর পক্ষে গত ৭ নভেম্বর এক বছরের জন্য মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিতের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। উচ্চ আদালতে মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করা যায়নি। আসামিপক্ষের কারণে মামলার বিচারিক কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করলে আমরা এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করতে পারি।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের দুই মামলায় প্রায় ছয় বছর আগে অভিযোগ গঠন হয়েছে। কয়েকজন আসামি উচ্চ আদালতে মামলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন। অভিযোগ গঠনের প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর পর হত্যা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। ইমারত নির্মাণ আইনের মামলাটিতে এক আসামির পক্ষে স্থগিতাদেশ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি। মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা ছাড়া সবাই জামিনে আছেন। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত দ্রুত স্থগিতাদেশ নিষ্পত্তি করে মামলার কার্যক্রম চালু করা।
হত্যা মামলা
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে ধসে পড়ে সাভারের রানা প্লাজা ভবন। এর নিচে চাপা পড়েন সাড়ে পাঁচ হাজার পোশাকশ্রমিক। ওই ঘটনায় এক হাজার ১৩৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আহত ও পঙ্গু হন প্রায় দুই হাজার শ্রমিক। ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে দুই হাজার ৪৩৮ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।
ওই ঘটনায় সাভার থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ ভবন নির্মাণে ‘অবহেলা ও ত্রুটিজনিত হত্যা’ মামলা করেন।
২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ৫৯৪ জনকে। মামলার ৪১ আসামির মধ্যে ভবন মালিক সোহেল রানার বাবা আব্দুল খালেক, আবু বক্কর সিদ্দিক ও আবুল হোসেন মারা যান। তিনজনকে বাদ দিয়ে হত্যা মামলায় এখন আসামির সংখ্যা ৩৮ জন।
২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি মামলার বাদী সাভার থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ আদালতে সাক্ষ্য দেন। ১৬ এপ্রিল তার সাক্ষ্য জেরা শেষ করেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। আগামী ২৯ মে মামলাটির পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
ইমারত নির্মাণ আইনে মামলা
একই ঘটনায় ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় রাজউকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. হেলাল উদ্দিন ওইদিন সাভার থানায় অন্য মামলাটি করেন। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয়কৃষ্ণ কর ভবনের মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলায় সাক্ষী করা হয় ১৩০ জনকে।
২০১৬ সালের ১৪ জুন ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। বর্তমানে ওই আদালতে মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। অভিযোগ গঠন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একজনেরও সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি।
দুই মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, তার মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কমিশনার হাজি মোহাম্মদ আলী, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (আর্কিটেকচার ডিসিপ্লিন) এ টি এম মাসুদ রেজা, প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসাইন, সাভার পৌরসভার সাবেক মেয়র মো. রেফাতউল্লাহ, সাভার পৌরসভার সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, সাবেক উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, সাভার পৌরসভার সাবেক টাউন প্ল্যানার ফারজানা ইসলাম, লাইসেন্স পরিদর্শক মো. আব্দুল মোত্তালিব, পৌরসভার সাবেক সচিব মর্জিনা খান, সাবেক সচিব মো. আবুল বাশার, ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের এমডি বজলুস সামাদ ও ইথার টেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. আনিসুর রহমান।
তিন বছরের কারাদণ্ড রানার
এদিকে ভবন ধসের পর পালিয়ে যাওয়া রানাকে কয়েকদিন পর যশোর থেকে গ্রেফতার করা হয়। তখন থেকে জেলে তিনি। গ্রেফতারের পর রানার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হয়। সম্পদের হিসাব দাখিল না করায় দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করে।
ওই মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬ এর বিচারক কে এম ইমরুল কায়েস। একই সঙ্গে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
সূত্র: জাগো নিউজ