শিরোনাম
যুক্তরাষ্ট্রের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়মুক্তি দেওয়া হয় বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা নাকচ করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেছেন, অতীতে সেভাবে দেওয়া না হলেও র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতজন সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সে তথ্য বিস্তারিতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দিয়েছে বাংলাদেশ।
আজ বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তার দপ্তরে সাংবাদিকদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনের বিষয়ে এ মন্তব্য করেন।
শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘প্রতিবেদনটি কেবল প্রকাশিত হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রতিবেদনটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ শুরু করেছে। মার্কিন প্রশাসন এক বছরব্যাপী এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে, যেখানে তাদের অনেক রিসোর্স এতে খরচ হয়েছে। এমন একটি প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া কয়েক ঘণ্টায় দেওয়া সম্ভব নয়। আমরা আগামী রোববারে এ নিয়ে বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া গণমাধ্যমে জানাব। পরবর্তী সময়ে অবশ্যই মার্কিন সরকারের বেশ কিছু বৈঠক আছে, সেখানে এ বিষয়ে আলাদাভাবে কথা বলব। এগুলোর প্রতিটি বিষয় নিয়ে তাদের কাছে জানতে চাইব এবং আমাদের অবস্থান কোথায় কী আছে সেটাও তাদের জানাব।’
শাহরিয়ার আলম জানান, মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনটি শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মানবাধিকার বলতে দু–তিনটি বিষয় নয়। এখানে শিশুদের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করা হয়, রোহিঙ্গাদের কীভাবে দেখা হয়, অভিবাসীদের প্রতি কেমন আচরণ, সেসব বিষয়ও উল্লেখ থাকে। সামগ্রিকভাবে এই প্রতিবেদনের ব্যাপ্তি ব্যাপক।
সর্বশেষ মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনের বিষয়ে হতাশা প্রকাশ করে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘খুবই দুঃখের ও পরিতাপের বিষয় হলো অতীতের বছরগুলোর মতো একটি ধারাবাহিকতা প্রতিবেদনে আছে। একটা গৎবাঁধা বিষয় আছে। বাংলাদেশে সরকারবিরোধী যেসব প্রপাগান্ডা মেশিন আছে সে মেশিনগুলো থেকে প্রাথমিকভাবে তথ্য নেওয়া হয়েছে বলে মনে করি।’
মার্কিন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়মুক্তি দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে শাহরিয়ার আলম বলেন, দায়মুক্তির প্রসঙ্গটি মোটেও ঠিক নয়। আবারও বলব, র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসার পর আমরা কিন্তু এই ডকুমেন্টগুলো দিয়েছি। আমরা পরিষ্কারভাবে গত তিন বছরে কতজন পুলিশ, কতজন র্যাবের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা তাদের দিয়েছি। কাজেই সেটা শুধু দু–একজন কর্মকর্তার ক্ষেত্রে নয়। অথচ এই প্রতিবেদনে বলা আছে, দু–একটি ক্ষেত্রে। যখন ১৭০ বা ১৯০ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়, তখন সেটি নিশ্চয়ই দু–একটির সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর সব দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যায়। রোহিঙ্গা শিবিরে গতকালও নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে একজন মারা গেছেন। প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছেন। সেখানে আমাদের র্যাব ও পুলিশ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে যাবে তখন যদি তাকে গুলি চালাতে হয় কেউ যদি মারাও যান, সেটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে এমন অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
মানবতা নিয়ে নৈতিকতার স্খলন
মার্কিন প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এতে কয়েকটি বিষয়ে সুস্পস্ট অসংগতির বিষয় তুলে ধরেন। ২০১৭ সালে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসার পর রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ। অথচ রোহিঙ্গা বিষয়ক সনদ সইয়ের প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশকে মানবিকতা শেখানো মানে নৈতিক স্খলন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শাহরিয়ার আলম বলেন, বাংলাদেশ শরণার্থীদের মর্যাদাসংক্রান্ত ১৯৫১ সালের সনদ এবং এ সম্পর্কিত ১৯৬৭ সালের প্রটোকল স্বাক্ষর করেনি। এটা আমরা সব সময় বলি, আবার এটাও আমরা বলি যে ওই প্রটোকলের স্বাক্ষরকারী দেশ না হলেও এর সবগুলো শর্ত বাংলাদেশ মেনে চলে। কেন বাংলাদেশ এটা সই করেনি, সেই ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। অথচ এই প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে তা ভুল এবং মিথ্যা। রোহিঙ্গা সনদ সই না করলেও এর মূল স্পিরিট ধারণ করেই তাদের শরণার্থী নামে অভিহিত না করার পরও বাংলাদেশ তাদের যথেষ্ট সুযোগ–সুবিধা দিচ্ছে। অথচ এখানে (প্রতিবেদনে) বলা হয়েছে, আমরা নাকি ব্যাখা দিয়ে বলি আমরা সই করিনি (সনদ ও প্রটোকল) বলে আমরা কোনো দায়িত্ব নেই না।
রোহিঙ্গাদের বিষয়েও ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘১০ থেকে ১২ জন রোহিঙ্গা ভাসানচর থেকে পালানোর সময় নৌকাডুবি হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এটাও কি আমাদের দোষ? আমাদের ঘাড়ে এ দোষ চাপানো হয়েছে।’
কোনো চাপেই সমকামী অধিকার নয়
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এলজিবিটিদের জন্য বাংলাদেশে যথেষ্ট আইন নেই এবং বাংলাদেশ তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না— প্রতিবেদনের এই অংশের বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘পৃথিবীর এমন একটি মুসলিম দেশ দেখান যারা এলজিবিটিকে অনুমোদন দেয়। এটা আমাদের ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী। প্রায় সকল ধর্মের পরিপন্থী। বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রে যত চাপই দেওয়া হোক না কেন, এটা কখনো মেনে নেওয়া হবে না। এখানে কখনো ছাড় দেওয়া হবে না। কারণ, এটা বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে, ধর্মের সঙ্গে বিরোধিতা করা হবে।’
শাহরিয়ার আলম বলেন, আমাদের প্রত্যাশা, আমাদের বন্ধুরা আমাদের এখানকার বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জগুলো বুঝবেন। আমাদের সংবিধান, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাষার প্রতি যথেষ্ট সম্মান রেখে দয়া করে এলজিবিটি দাবিগুলো যেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের ওপর নিয়ে আসার চেষ্টা না করেন।
খালেদা জিয়া প্রসঙ্গ
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার মামলার ইতিহাসও এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে রাজনৈতিক বন্দি বলা হয়েছে। তিনি তো রাজনৈতিক বন্দী নন। আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যতবার এ নিয়ে কথা বলেছি, সেখানে আমরা সব প্রশ্নের উত্তর খোলাসা করে বলেছি। তাকে মানবিক কারণে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে বাসায় থাকতে দেওয়া হয়েছে। তার বিদেশে যাওয়ার প্রশ্নটাও অমূলক ছিল, এটা প্রমাণিত হয়েছে যখন তিনি নিজে হেঁটে বা হুইল চেয়ার বসে গেছেন হাসপাতালে।
সূত্র: প্রথম আলো