শিরোনাম
সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিম শিপনকে যেভাবে হত্যা করা হয় তা বর্বরতার সকল সীমা অতিক্রম করেছিল। এমন তথ্যই তদন্তে উঠে এসেছে বলে পুলিশ সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানা যায়, এএসপি আনিসুল করিম শিপন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন। যে কোনো আঘাতে তার মৃত্যু ঘটার আশঙ্কা ছিল। এ কথা জানার পরও চিকিৎসার নামে তাকে মাইন্ড এইড হাসপাতালের অ্যাগ্রেসিভ রুমে ঢুকিয়ে অপেশাদার লোক দিয়ে ম্যাট্রেসের ওপর ফেলে দুই হাত বেঁধে নয়জন আসামি মিলে বুক, ঘাড় ও মাথায় আঘাত করেন। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন আরিফ মাহমুদ জয়। তারা সেদিন এএসপি আনিসুলের মাথার ওপর চেপে বসে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেছিল।
সরকার অনুমোদিত কোনো হাসপাতালে ভর্তি না করিয়ে এএসপি আনিসুলকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুন অর্থ উপার্জনের অসৎ উদ্দেশ্যে, ইচ্ছাকৃতভাবে মাইন্ড এইড হাসপাতালে পাঠান। দৈহিক জখম বা আঘাত বিপজ্জনক এবং মৃত্যু ঘটাতে পারে বা মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে, তা জানতেন ডা. মামুন।
রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে এএসপি আনিসুলের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ডা. মামুনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে দেওয়া অভিযোগপত্রে (চার্জশিট) এসব কথা উল্লেখ করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানা পরিদর্শক (অপারেশন) ফারুক মোল্লা। গত ৯ মার্চ তিনি এ অভিযোগপত্র দেন।
কোনোভাবে হত্যার দায় এড়াতে পারেন না ডা. মামুন
মামলার চার্জশিটে বলা হয়, আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালটি কেবল অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার জন্য মালিকপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থার অনুমতি নেয়নি। সেখানে অত্যাবশ্যকীয় কোনো জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জম এবং সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও নেই। মাইন্ড এইড হাসপাতালটির সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে রেজিস্ট্রার ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন আগে থেকেই জানতেন। এরপরও তিনি সেখানে নিয়মিত চেম্বার করতেন এবং সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মাইন্ড এইড হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিতেন।
চার্জশিটে বলা হয়, দৈহিক জখম বা আঘাত মৃত্যু ঘটাতে পারে বা মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে মর্মে চিকিৎসক হিসেবে ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন জানতেন। সুতরাং এ হত্যার দায় তিনি কোনোভাবে এড়াতে পারেন না।
মধ্যযুগীয় কায়দায় আঘাত করা হয় এএসপি আনিসুলকে
মামলার চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা ফারুক মোল্লা আরও উল্লেখ করেন, আসামি আরিফ মাহমুদ জয় ও তানিফ মোল্লা আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুনের সম্পৃক্ততার তথ্য প্রকাশ করেছেন। ডা. মামুনের ইচ্ছেতেই ভুক্তভোগীকে মাইন্ড এইড হাসপাতালে পাঠানো, রোগী পাঠানোর বিষয়ে মোবাইল ফোনে কথোপকথনের সিডিআর, ভিকটিমকে চিকিৎসা দেওয়ার নামে মধ্যযুগীয় কায়দায় আঘাত করা ও মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে হৃদরোগ হাসপাতালে বা অন্যত্র ভর্তি দেখিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে মর্মে প্রচেষ্টা চালানো, এসব কার্যক্রম মামলার ঘটনায় সমর্থনযোগ্য সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচ্য। তাই ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন পেনাল কোড ৩০২/১০৯ ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ সংঘটন করেছেন মর্মে প্রাথমিকভাবে তদন্তে প্রমাণিত হয়।
আরিফের নেতৃত্বে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন ৯ আসামি
মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, আসামি আরিফ মাহমুদ জয়ের নেতৃত্বে এজাহারনামীয় আসামি মাসুদ খান (বাবুর্চি), সজীব চৌধুরী (ওয়ার্ড বয়), অসীম কুমার পাল (ওয়ার্ড বয়), তানিফ মোল্যা (ওয়ার্ড বয়), লিটন আহম্মেদ (দারোয়ান), জোবায়ের হোসেন (ওয়ার্ড বয়), তানভীর হাসান (ফার্মাসিস্ট) এবং সাইফুল ইসলাম পলাশ (ওয়ার্ড বয়) চিকিৎসা দেওয়ার নামে ভিকটিম আনিসুল করিমকে পিটিয়ে হত্যা করেছেন, যা পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ অপরাধ।
মাইন্ড এইড হাসপালে ছিল না কোনো মানসিক রোগের চিকিৎসক
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আরও বলেন, মামলার আসামি মুহাম্মদ নিয়াজ মোর্শেদ ওরফে সোহাগ (মাইন্ড এইড হাসপাতালের এমডি) ও ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুন বেসরকারি হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। তারা মানসিক রোগীর চিকিৎসক নন। অন্যদিকে আসামি ফাতেমা খাতুন ময়না বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুধুমাত্র মনোরোগ বিষয়ে একটি কোর্স সম্পন্ন করেছেন। তিনিও মানসিক রোগের চিকিৎসক নন। হাসপাতালের অন্য মালিকদের মধ্যে রেদোয়ান সাব্বির (কো-অর্ডিনেটর), সাজ্জাদ আমিন, সাখাওয়াত হোসেন কেউই মানসিক রোগের চিকিৎসক নন।
মাইন্ড এইড হাসপাতালে চিকিৎসার নামে প্রতারণা
তদন্ত কর্মকর্তা ফারুক মোল্লা চার্জশিটে বলেন, হাসপাতালের মালিকরা বিধিবহির্ভূতভাবে শুধু অবৈধ অর্থ উপার্জনের অভিপ্রায়ে মানসিক চিকিৎসা দেওয়ার নামে প্রতারণার মাধ্যমে মাইন্ড এইড নামক হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করেন। হাসপাতালটিতে অভিজ্ঞ কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিল না। তাছাড়া অবৈধ হাসপাতালটিতে জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা নেই। সুতরাং অবৈধভাবে প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালটির উল্লিখিত মালিকরা এ হত্যাকাণ্ডের দায় এড়াতে পারেন না। হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার মাধ্যমে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটিকে ত্বরান্বিত ও প্ররোচিত করেছেন, যা পেনাল কেডের ৩০২/১০৯ ধারায় শান্তিযোগ্য অপরাধ।
মামলার তদন্তকালে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ, তথ্য-উপাত্ত, জব্দ আলামত, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনা ও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতায় আসামি আরিফ মাহমুদ জয় (৩৫), মাসুদ খান (৩৮), জোবায়ের হোসেন (১৯), তানিফ মোল্যা (২০), তানভির হাসান (১৮), সজীব চৌধুরি (২১), অসীম কুমার পাল (২৪), লিটন আহম্মেদ (১৮) ও সাইফুল ইসলাম পলাশের (৩৫) বিরুদ্ধে মামলার অপরাধ পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারায় এবং আসামি রেদোয়ান সাব্বির, ফাতেমা খাতুন ময়না (৪১), এজাহারনামীয় পলাতক আসামি আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাখাওয়াত হোসেন রেমন, সাজ্জাদ আমিন এবং তদন্তে প্রাপ্ত আসামি রেজিস্ট্রার ডা. আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মামলার অপরাধ পেনাল কোডের ৩০২/১০৯ ধারা মোতাবেক প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। মামলার গ্রেফতার হওয়া অপর আসামি মুহাম্মদ নিয়াজ মোর্শেদ ২০২১ সালের ৫ নভেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যাওয়ায় মামলার দায় হতে তার অব্যাহতির আবেদন করা হয় চার্জশিটে।
২০২০ সালের ৯ নভেম্বর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. আনিসুল করিম শিপন রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। সে সময় হাসপাতালে তাকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ আনা হয়।
এ ঘটনায় ১০ নভেম্বর আদাবর থানায় আনিসুল করিম শিপনের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ বাদী হয়ে ১৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার দুই আসামি পলাতক রয়েছেন। তারা হলেন- মো. সাখাওয়াত হোসেন ও সাজ্জাদ আমিন।
এ মামলার আসামি মাইন্ড এইড হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, পরিচালক ফাতেমা খাতুন ময়না, মুহাম্মাদ নিয়াজ মার্শেদ, কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির, কিচেন সেফ মো. মাসুদ, ওয়ার্ড বয় জোবায়ের হোসেন, ফার্মাসিস্ট মো. তানভীর হাসান, ওয়ার্ড বয় মো. তানিম মোল্লা, সজীব চৌধুরী, অসীম চন্দ্র পাল, মো. লিটন আহাম্মদ, মো. সাইফুল ইসলাম পলাশ কারাগারে আছেন।
অন্যদিকে মামলায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেজিস্ট্রার মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন জামিনে আছেন। এ মামলায় আসামি কিচেন সেফ মাসুদ খান, ওয়ার্ড বয় অসীম চন্দ্র পাল, মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়, সজিব চৌধুরী, হাসপাতালের ফার্মাসিস্ট মো. তানভীর হাসান ও ওয়ার্ড বয় মো. তানিম মোল্লা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
মামলার বাদী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, আমার ছেলে আনিসুল করিম শিপন হত্যা মামলায় ১৫ আসামির বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দাখিল করেছে। মামলাটি যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয়, এ প্রত্যাশা করছি। আসামিদের শাস্তি হলেই আমি শান্তি পাবো।
সূত্র: জাগো নিউজ