দেশব্যাপী কৃষকের স্বপ্ন পূরণ করছে ‘কালো সোনা’

ফানাম নিউজ
  ১৯ মার্চ ২০২২, ১২:৫০

ফুল সাদা হলেও বীজ কালো। কিন্তু স্বর্ণের মতো দাম। তাই কৃষকসহ জেলাবাসীর কাছে এর নাম ‘কালো সোনা’। পেঁয়াজ বীজের ক্ষেত দূর থেকে মনে হয় ভিন্ন কোনো সাদা রঙের ফুলের বাগান। আর সাদা ফুলের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কৃষকের সোনালী স্বপ্ন।

ফরিদপুরের এ কালো সোনার কদর রয়েছে দেশব্যাপী। দেশের ৭৫ শতাংশ পেঁয়াজের বীজের চাহিদা মেটায় ফরিদপুরের এই কালো সোনা। অন্যবারের মতো এবারও ফরিদপুরে মাঠের পর মাঠ আবাদ হচ্ছে পেঁয়াজ বীজের। প্রতিটি পেঁয়াজ গাছে শোভা পাচ্ছে সাদা রঙের ফুল। এই গোলাকৃতি কদম ফুলের মতো সাদা ফুলের মধ্যে লুকিয়ে আছে মূল্যবান পেঁয়াজ বীজ। কেবল জেলা নয়, জেলার গণ্ডি পেরিয়ে দেশজুড়ে পেঁয়াজ চাষিদের স্বপ্ন দেখান ফরিদপুরের বীজ চাষিরা। জেলার চাহিদা মেটানোর পর এই পেঁয়াজ বীজ ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে পেঁয়াজ দানা রোপণ শুরু করা হয়। মার্চ ও এপ্রিলে দানা থেকে ফুল পেকে কালো বীজে রূপান্তর হয়। পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের দিক দিয়ে ফরিদপুর জেলা দেশসেরা। সারা দেশে পেঁয়াজের বীজ উৎপাদন হয় শতকরা ২৫ ভাগ। আর শুধু মাত্র ফরিদপুরে এর উৎপাদন হয় প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ। গত মৌসুমের মতো ভালো দর পেলে এবারও বিক্রি হবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার। এমনটাই দাবি চাষিদের।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্র মতে, এ বছর জেলায় ১৭ হাজারের অধিক হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ বীজের আবাদ হয়েছে। যা থেকে প্রায় ৯শ’ থেকে এক হাজার মেট্রিক টন বীজ উৎপাদনের সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৬শ’ কোটি টাকা।

মোট ৯ উপজেলা নিয়ে গঠিত ফরিদপুর জেলা। সব উপজেলায় কমবেশি পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন হয়। তবে সদরের অম্বিকাপুর ও ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নেই দেশের ৫০ শতাংশ বীজ উৎপাদন হয়। পেঁয়াজের রাজধানী বলা হয় সালথা উপজেলাকে।

সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, পেঁয়াজ বীজ চাষিদের মুখে হাসি ফুটেছে। বীজ ঘরে তোলার জন্য চাষিদের অপেক্ষা আর প্রস্তুতি চলছে। ভালোভাবে বীজ ঘরে তুলতে পারলে বিঘা প্রতি পৌনে তিন লাখ টাকা লাভের আশা করছেন বীজ চাষিরা। ফরিদপুরের সদরপুর, ভাঙ্গা, নগরকান্দা, সালথা ও সদর উপজেলা পেঁয়াজের বীজ চাষাবাদের জন্য বেশ প্রসিদ্ধ। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় পেঁয়াজ বীজের বাম্পার ফলন হবে এমনটাই আশা নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন চাষিরা।

সদর উপজেলার চাষি জামাল তালুকদার, জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এবার আবহাওয়া ছিল অনুকূলে। বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা। বীজ ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগ না হলে বিঘা প্রতি গড়ে সাড়ে তিন মণের মতো পেঁয়াজ বীজ পাওয়া যাবে। যার বর্তমান বাজার দর ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার মতো। যদিও সামনে বাড়তে বা কমতে পারে।

শেখ সেলিম, শেখ হাবিবুর রহমান বলেন, আমাদের দাবি প্রতি বছরের মতো এবারও যেন সরকার বিএডিসির মাধ্যমে চাষিদের কাছ থেকে এই বীজ সংগ্রহ করেন।

গোবিন্দুপুর গ্রামের পেঁয়াজ বীজ চাষী শফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকার আবহাওয়া বীজ উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। তবে ব্যাংকগুলো শুধু জমির মালিকদের লোন দেয়, আমার মতো বর্গা চাষিদের লোন দেয় না। আমরা বাধ্য হয়ে এনজিও থেকে অধিক সুদে লোন নিয়ে পেঁয়াজ বীজ চাষ করি।

দেশসেরা পেঁয়াজ বীজ চাষী ও নারী কৃষক ফরিদপুরের সদর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামের শাহিদা বেগম। তিনি প্রায় দেড় যুগের বেশি সময় ধরে পেঁয়াজ বীজ চাষ করছেন। তিনি নানা পদকে ভূষিত হয়েছেন। পেঁয়াজ বীজ চাষে অনন্য উদাহরণ স্থাপন করা শাহিদা বেগমের পেঁয়াজ বীজের নাম ‘খান বীজ’।

তিনি এ বছর সেরা নারী কৃষক হিসেবে পেয়েছেন ‘স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড চ্যানেল আই এগ্রো অ্যাওয়ার্ড’। এছাড়াও তিনি ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ বিএডিসির চুক্তিবদ্ধ কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছেন।

নারী কৃষক শাহিদা বেগম বলেন, দেশের মোট চাহিদার পেঁয়াজ বীজের ৪ ভাগের একভাগ বীজ আমার জমি থেকে উৎপাদিত হয়। ২০২১ সালে আমার চাষ করা প্রায় দুইশ মণ পেঁয়াজ বীজ বিক্রি করে পেয়েছি প্রায় ৪ কোটি টাকা।

ফরিদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. হযরত আলী বলেন, চলতি মৌসুমে ফরিদপুর জেলায় প্রায় ৯শ’ মেট্রিক টনের অধিক পেঁয়াজ বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। সরকারের বিএডিসির সংগৃহীত মোট পেঁয়াজ বীজের ৭০ শতাংশ ফরিদপুর জেলা থেকে উদপাদিত হয়ে থাকে। এ বীজ উৎপাদন করে রবি মৌসুমে চাষিরা অধিক মুনাফা অর্জন করে থাকেন। সোনার থেকেও এর মূল্য বেশি। এই কারণে এ বীজকে ‘কালো সোনা’ হিসেবে অভিহিত করা হয়।

সূত্র: জাগো নিউজ