পণ্যের দামে পিষ্ট ভোক্তা

ফানাম নিউজ
  ১৬ মার্চ ২০২২, ০৩:৪৯

বাজারে খাদ্যপণ্যের সঙ্গে বাড়ছে সব ধরনের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম। এমনিতেই চাল থেকে শুরু করে ডাল ভোজ্যতেলসহ সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তি।

এর সঙ্গে দীর্ঘদিন নিয়ন্ত্রণে থাকা-সাবান, টুথপেস্ট, ডিটারজেন্ট, নারিকেল তেল, সেইভ করার রেজার, এয়ার ফ্রেশনার, অ্যারোসলসহ সব ধরনের নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দামও লাগামহীন হয়ে পড়েছে।

গত তিন মাসের ব্যবধানে পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে আয় বাড়েনি। ফলে সব মিলিয়ে বাড়তি দামের বোঝা সইতে না পেরে পিষ্ট হচ্ছেন ভোক্তা।

এদিকে একসঙ্গে এতকিছুর দাম বাড়ায় আয়ের সঙ্গে ব্যয় সামলাতে ক্রেতাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এ জন্য অনেকেই প্রতিদিন ব্যবহার্য পণ্যের তালিকা কাটছাঁট করছেন। এ যেন অল্প কিছু দিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই। পাশাপাশি সকালের নাস্তার টেবিলে রাখা পাউরুটির দামও বেড়েছে। আকার ভেদে ১০-২০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। রাস্তার পাশে হোটেলে পরোটার দাম না বাড়ালেও ব্যয় সামলাতে এর আকার ছোট করা হয়েছে। হোটেল রেস্তোরাঁগুলোতেও সব ধরনের খাবারের দাম বেড়েছে।

ব্যবসায়ীদের দাবি-করোনা পরবর্তীকালে চাহিদা বাড়া ও সরবরাহ ব্যবস্থায় সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। গত ৩ নভেম্বর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ফলে গণপরিবহণ ভাড়া প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। এর প্রভাবেও ওই সময়ে এক দফা পণ্যের দাম বেড়েছে। শিল্প পণ্যে পণ্যের দাম বাড়ার প্রভাব পড়ছে সাম্প্রতিক সময়ে। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে নিত্যপণ্য সব ধরনের পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে আরও এক দফা বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারেও।

এদিকে জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়ায় ওইসব দেশে পণ্য পরিবহণ ও বিপণন খরচ বেড়েছে। এতে আন্তর্জাতিক বাজারেও সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম বেড়েছে। বেশি দামে কেনার কারণে স্থানীয় বাজারেও এর প্রভাব পড়েছে। তবে সয়াবিন তেলের দাম বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করে বলে এর দাম ব্যবসায়ীরা ইচ্ছেমতো বাড়াতে পারছে না।

গত আগস্টের পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে জাহাজ ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪৫ শতাংশ, শিল্পের কাঁচামালের দাম গড়ে ৩৫ শতাংশ, গমের দাম ২৪ শতাংশ বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে স্থানীয়ভাবে পরিবহণ ব্যয়ও বেড়েছে।

সম্প্রতি রাজধানীর একাধিক ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ঘুরে ও বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনাকালে লাইফবয় সাবান বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা যা এখন ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিন মাসের ব্যবধানে প্রতি পিস লাক্স সাবান ৫২ টাকা ছিল, এখন ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি হুইল পাউডারের দাম করোনাকালে ছিল ৮৫ টাকা। এই পণ্যটির দাম এখন ১০০ টাকা। এক কেজি রিম পাউডার ১০৫ টাকা এমআরপি ছিল, এখন ১৪০ টাকা। ১০০ টাকার পেপসোডেন্ট টুথটেস্ট এখন ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি ছোট সাইজের অ্যানার্জি বিস্কুটের দাম ৩০ টাকা যা আগে ২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি সাইজের প্যাকেটজাত চানাচুর বিক্রি হয়েছে ৪৩ টাকা, যা আগে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। ওয়ানটাইম সেইভ করার রেজার বিক্রি হয়েছে ২০ টাকা, যা আগে ১৫ টাকা ছিল। ২৫০ এমএলের প্যারাসুট বোতলজাত নারিকেল তেল ১৪৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা আগে ১৩৫ টাকা ছিল। ৪০০ এমএলের অ্যারোসল ৪৯৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ৪০০ টাকা ছিল। ২২০ টাকার এয়ার ফ্রেশনার ২৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক ড. এমকে মুজেরি বলেন, যেকোনো ব্যক্তিগোষ্ঠীর হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা চলে গেলে ভোক্তার স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়। তাই ভোক্তার সুরক্ষা দিতে হলে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের দরকার প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। কিন্তু দেশে সেটি হচ্ছে না। কিছু ব্যক্তি-গোষ্ঠীর হাতেই নিত্যপণ্যের নিয়ন্ত্রণ। এরা কারসাজি করলে তখন সরকারের আর করার কিছু থাকে না। তিনি মনে করেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকবে। কিন্তু তার মানে এই নয়, এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা যা খুশি তাই করার সুযোগ পাবে। বিশ্বের অনেক দেশে মুক্তবাজার অর্থনীতি থাকলেও সরকারের হাতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও থাকে। বাংলাদেশেও এ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর জন্য দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর মনিটরিং সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি। দেশের প্রেক্ষাপটে ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা করা এখন দুরূহ ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে।

অন্য দিকে বাজার ঘুরে বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, খুচরা বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৬৮ টাকা যা তিন মাস আগেও ৬০-৬২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক কেজির প্যাকেটজাত আটা বিক্রি হয়েছে ৪৮ টাকা যা আগে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৮৫ টাকা যা আগে ৭৮-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি ছোট দানার মশুর ডাল ১৩০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে, আগে দাম ছিল ১১০ টাকা। প্রতি কেজি লবণের প্যাকেট বিক্রি হয়েছে ৩৫ টাকা, যা আগে ৩০-৩২ টাকা ছিল। প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৭০ টাকা যা আগে ১৫০ টাকা ছিল। গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৬০০-৬৭০ টাকা যা আগে ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানিবহির্ভূত পণ্যের দাম গড়ে ৫৫ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে শিল্পের যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, খাদ্যপণ্য ও অন্যান্য সেবা পণ্য রয়েছে। এগুলোর দাম বাড়ায় বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

রাজধানীর কাওরান বাজারে কথা হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. শাহ আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, বাজারে তদারকি করার মতো কেউ অছে কিনা জানি না। প্রত্যেকটি খাদ্যপণ্যের দাম বাড়তি। পাশাপাশি নিত্যব্যবহার্য পণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে। এতে প্রতিদিন আমার পরিবার সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যে বেতন পাই তা দিয়ে গত দুই বছর আগেও বেশ ভালো ছিলাম। এখন সব ধরনের পণ্যের দামে দিশেহারা হয়ে পড়েছি। তাই যে পণ্য না কিনলেই নয়, তা বাদ দিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছি। 

জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, অসাধুদের কারসাজির কারণেই মূলত এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। নানা ইস্যুতে গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে দেশে বেশ কিছু আইন আছে, সেসব আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ব্যবসায়ীদের সচেতনতা অনেক বড় ব্যাপার। তারা যৌক্তিক লাভ করবে এটাই আমরা চাই। কিন্তু কেউ যদি কারসাজি করে এদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমাদের অভিযান টিম প্রতিনিয়ত তদারকি করছে। অনিয়ম পেলে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

সূত্র: যুগান্তর