শিরোনাম
১৯৭১ সাল। এক ভয়াল রাত। পাক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের ক্ষত নিয়ে এখনো বেঁচে আছেন বীরাঙ্গনা আলেয়া বিবি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে আলেয়া বিবি বলেন, পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন নিয়ে দুর্বিষহভাবে স্বাধীনতার ৫০টি বছর অতিক্রান্ত করছি। ১৯৭১-এ পাক হানাদার বাহিনীর বর্বর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে দাদা, চাচিসহ ১০-১২ জনকে চোখের সামনে হত্যা করে অমানুষিক নির্যাতন, নিপীড়ন চালিয়েছে।
আলেয়া বিবি জানান, কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার আমড়াতলী ইউপির ভুবনঘর গ্রামে তার বাড়ি। বাবা আবদুল কাদের, মাতা শামসুন নাহার। দুই ভাই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাবা ছিলেন একজন সামান্য কৃষক। জন্মসন-তারিখ কিছুই মনে নেই।
তিনি বলেন, আমাদের বাড়িটি ছিল রাস্তার একেবারে পাশে। তখন আমার বয়স ১৪-১৫ বছর হবে। আমরা কয়েকজন মেয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। এমন সময় লক্ষ্য করলাম আর্মি আসছে। খাকি পোশাক পরিহিত পাক আর্মিদের দেখে আমরা ভয়ে বাড়ি চলে এলাম। পেছনে ফিরে দেখি আর্মির লোকগুলো আমাদের বাড়িতেই আসছে। দৌঁড় দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকতেই পেছনে চুলের মুঠি ধরে দিল এক টান। পেছনে ফিরে দেখি বড় মোছওয়ালা এক আর্মি। তার পেছনে আরো কয়েকজন। হনুমানের মতো তারা কিছুক্ষণ আমাকে নিয়ে খেলল। আমি চিৎকার দিতেই বেরিয়ে এলো আমার দাদা ও চাচি। পাক আর্মিদের কাছ থেকে তারা আমাকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতেই গুলি করে আমার সামনেই দাদা ও চাচিকে তারা হত্যা করল। পুরো উঠান রক্তে লাল হয়ে উঠল। যখন আমার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক হাত চলে এলো তখনও আমার হিতাহিত জ্ঞান ছিল। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে এক আর্মির গালে দিলাম একটা থাপ্পড়। সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় আওয়াজ শুনলাম। অনুভব করলাম কে জানি আমার বাম হাতটা নিয়ে গেছে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে শুনেছি, ঐ দিনই আমাদের পার্শ্ববর্তী সালকমুড়া গ্রামে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়। ঐ যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়।
পরে সালকমুড়া যুদ্ধের কমান্ডার নায়েক সৈয়দ নজির, বর্তমান আদর্শ সদর উপজেলার সাংগঠনিক কমান্ডার মোশারফ হোসেন, আমড়াতলী ইউপির বর্তমান কমান্ডার রইছ ও ল্যান্স নায়েক আবদুল জলিলসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতায় আমাকে ভারতের আগরতলা হাসপাতালে পাঠানো হয়। দুই দিন পর যখন জ্ঞান ফিরে এলো, তখন দেখি আগরতলায় হাসপাতালের ৩ নম্বর বেডে শুয়ে আছি। আমার মাথার পাশে মা বাবা বসে বসে কাঁদছে। হাসপাতালের এক বড় ডাক্তার নাকি বলছে আমার বাম হাত কেটে ফেলতে হবে। আর পিঠসহ সারা শরীরে স্পিন্টার লেগে আছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত এই হাসপাতালে আমার চিকিৎসা করা হয়েছে। সম্ভবত দেশ স্বাধীনের ১২-১৩ দিন পর আমার বাবাকে হাসপাতাল থেকে বলল, তোমার মেয়ে এখন কিছুটা সুস্থ। তোমাদের জেলার সদর হাসপাতালে নিয়ে আরো কিছু দিন রাখলে ভালো হয়ে যাবে। দুই দিন পর আমাকে আগরতলা থেকে কুমিল্লা সদর হাসপাতালে এনে ভর্তি করানো হয়। এখানে কত দিন ছিলাম মনে নেই। এক সময় বাড়ি যাই। সারা জীবনের জন্য আমার বাম হাত পঙ্গু হয়ে যায়। পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যা এলে সারা শরীরে এখনো ব্যথা পাই।
হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পর অনেকেই আমার সঙ্গে পাকবাহিনীর আচরণ নিয়ে মাঝে মাঝে নানা কথা বলতো। এ জন্য অনেকেই আমাকে বিয়ে করতে চাইতো না। ১৯৭৮ সালে ব্রাহ্মণপাড়ার সদর ইউপির নাইঘর গ্রামে আমার বিয়ে হয়। বর্তমানে আমার ২ ছেলে ও ৩ মেয়ে আছে।
তিনি বলেন, আমার স্বামী এখন কৃষি কাজও করতে পারছেন না। ছেলে দু’জন দিন আনে দিন খায়। ছোট এই ঘরটিকে কোনো মতে থাকি। অমাবস্যা, পূর্ণিমা এলে সারা শরীর জ্বালা-পোড়া করে। কিছুদিন পরপর ডাক্তার দেখাতে হয়। এমনিতেই তিন বেলা খেতে পারি না। তার ওপর ডাক্তার দেখাব কি করে।
আলেয়া বিবি বলেন, আমি বিশ্বাস করি সরকার যদি আমার কথা শুনে তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করবেন।
আলেয়া বিবির স্বামী মো. ইউনুছ মিয়া বলেন, সেদিন অনেকেই আমাকে পাক বাহিনীর নির্যাতনের কথা বলে তাকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু তাদের কথা শুনিনি। অন্যায় যদি করে থাকে পাক হানাদাররা করেছে, এই মেয়ের তো কোনো দোষ ছিল না। শারীরিক অবস্থার কারণে আমার সংসার নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও কোনো দিন তাকে কিছু বলিনি, তার অমর্যাদা করিনি। নানা কারণে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হইনি। এই বীরাঙ্গনা নারীকে বিয়ে করে পরোক্ষভাবে হলেও কিছুটা অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছি এটাই আমার সান্তনা।
বীরাঙ্গনা আলেয়া বিবির চাওয়া এখন শুধু মাত্র একটি ঘর। এই একটি ঘর করে দিলেই তিনি শান্তি পাবেন বলে জানান।
সূত্র: ডেইলি বাংলাদেশ