শিরোনাম
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য হতে যাচ্ছে ১৭২ কিলোমিটার। এর মধ্যে ২৩ কিলোমিটার হবে পুরোপুরি এলিভেটেড (উড়াল)। যশোর পর্যন্ত রেলপথের কোথাও থাকবে না কোনো লেভেল ক্রসিং। এতে সময় বাঁচবে, ঘটবে না দুর্ঘটনা।
তথ্যসূত্র বলছে, দেশে উড়াল ও লেভেল ক্রসিংবিহীন প্রথম রেলপথ হতে চলেছে এটি। সেতুর পাশাপাশি পুরোদমে এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজও। তবে চলতি বছর সড়ক সেতু খুলে দিলেও রেল চলতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত।
প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করা হবে রেলপথজুড়ে। পদ্মা, বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী নদী মাড়িয়ে নির্মিত হচ্ছে রেলপথ। নিচু জমিসহ নানান কারণে ২৩ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার রেলপথ হচ্ছে এলিভেটেড (উড়াল)। সাধারণত রেলপথ মানেই লেভেল ক্রসিংয়ের বিড়ম্বনা। তবে এই রেলপথের কোথাও থাকবে না ক্রসিং। ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা রোধে কোথাও নির্মিত হবে আন্ডারপাস কোথাও ওভারপাস।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্র জানায়, ২৩ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ নির্মাণ করা হবে তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে। প্রথম ভাগে (ভায়াডাক্ট-১ বা ভি-১) ঢাকার শ্যামপুর থেকে শুরু করে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কুচিয়ামোড়া পর্যন্ত ১৬ দশমিক ৭৭ কিলোমিটার। এই পথে পড়েছে বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদী। এছাড়া নিচু ভূমির কারণেই এ অংশে উড়াল রেলপথ নির্মিত হচ্ছে।
দ্বিতীয় ভাগের (ভি-২) আওতায় পড়ছে পদ্মা সেতুর কাছে মাওয়া অংশ। এ অংশে পদ্মা সেতু মূলত সড়কপথ থেকে অনেক উঁচু দিয়ে নির্মিত হয়েছে। সড়কপথের সঙ্গে মিল রেখে ২ দশমিক ৫৮ কিলোমিটার হচ্ছে উড়াল রেলপথ।
তৃতীয় অংশেও (ভি-৩) জাজিরায় উড়াল রেলপথ নির্মিত হবে। মাওয়ার মতো জাজিরা অংশেও অনেক উঁচু দিয়ে নির্মিত হয়েছে সড়কপথ। মূলত পদ্মা সেতুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এই উড়াল সড়ক নির্মিত হয়েছে। সড়কের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই অংশেও ৪ দশমিক ০৩ কিলোমিটার উড়াল রেলপথ নির্মিত হবে।
১০০টি ব্রডগেজ কোচ সংগ্রহ
প্রকল্পের আওতায় ১৭২ কিলোমিটার মেইন লাইন ও ৪৩ দশমিক ২২ কিলোমিটার লুপ লাইন নির্মাণ করা হবে। এই রেলপথে চলাচলের জন্য ১০০টি ব্রডগেজ রেল কোচ সংগ্রহ করা হবে। প্রকল্পের কাজ সঠিকভাবে বাস্তবায়নে অধিগ্রহণ করা হবে ২ হাজার ৪২৬ একর ভূমি।
নদী পেরিয়ে যাবে রেলপথ
পদ্মা রেলসংযোগ মানেই মহা কর্মযজ্ঞ। পদ্মা রেলসংযোগের কর্মযজ্ঞ ছড়িয়ে গেছে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নড়াইল ও যশোর জেলায়। রেলপথের জন্য কয়েকটা নদীতে দীর্ঘ রেলসেতু নির্মাণ করা হচ্ছে প্রকল্পের আওতায়।
পদ্মা রেলসংযোগ বুড়িগঙ্গা নদী পেরিয়ে যাবে। এজন্য বুড়িগঙ্গা নদীর উপরের ৪০০ মিটার দীর্ঘ আলাদা রেলসেতু নির্মিত হবে। এছাড়া মুন্সিগঞ্জের ধলেশ্বরী নদীতে ৫০০, আড়িয়াল খাঁ নদীতে ৬০০, নড়াইলের লোহাগড়ার মধুমতি নদীতে ১২০০, নবগঙ্গায় ১০০, যশোর ভৌরবে ৮০ ও খুলনার চিত্রা নদীতে ১০০ মিটার দীর্ঘ রেলসেতু নির্মাণ করা হবে। এসব প্রকল্পের ৫৮টি মেজর ব্রিজ, ২৭৩টি মাইনর ব্রিজ (কালভার্ট ও আন্ডারপাস) নির্মিত হবে।
ব্যালাস্টলেস উড়ালপথে রেলের গতি ১২০
বাংলাদেশের রেলপথ মানেই ব্যালাস্ট্রেড। এই রেলপথে গ্রানাইট পাথর ব্যবহার করা হয়। এই পথে থাকে ইস্পাতের স্লিপার ও কাঠের বন্ধন। রেললাইনে পাথর দেওয়ার কারণ হচ্ছে যাতে ট্রেন লাইনচ্যুত না হয়। তবে পদ্মা সেতু রেল সংযোগের উড়ালপথে কোনো পাথর থাকবে না। অত্যাধুনিক এই উড়াল রেলপথে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারবে ট্রেন।
দীর্ঘ পথে থাকছে না লেভেল ক্রসিং
বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলে ৯৭৮টি অনুমোদিত এবং ২৭১টি অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং রয়েছে। এসব লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ২২১টিতে রয়েছে গেটকিপার। ফলে ১ হাজার ২৮টি লেভেল ক্রসিং রয়ে গেছে অরক্ষিত। ফলে প্রতিনিয়তই ঘটছে দুর্ঘটনা, বাড়ছে প্রাণহানি। যেমন- কুড়িল ফ্লাইওভারের কাছে লেভেল ক্রসিংয়ে অধিকাংশ সময় ট্রেনে কাটা পড়ে পথচারী নিহত হন। সেখানে নেই কোনো গেটকিপার। তবে নতুন ঢাকা-যশোর নতুন ১৭২ কিলোমিটার রেলপথে থাকছে না কোনো লেভেল ক্রসিং। এতে একদিকে যেমন দুর্ঘটনা ঘটবে না, অন্যদিকে সড়কেও পড়বে না জটলা। ক্রসিং এড়াতে কোথাও কালভার্ট, আন্ডারপাস ও রেলওয়ে ওভারপাস নির্মিত হবে। ঢাকা থেকে গেন্ডারিয়া তৃতীয় ডুয়েলগেজ লাইন, ভাঙ্গা জংশনে ওভারহেড স্টেশন, কমলাপুরের টিটিপাড়ায় আন্ডারপাস, নড়াইলের তুলারামপুরে নতুন আন্ডারপাস নির্মিত হবে। রেলপথটি শতভাগ নিরাপদ করতেই এমন উদ্যোগ।
প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৫৪ শতাংশ
দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পের কাজ। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৫৪ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৫৪ দশমিক ৯ শতাংশ। তিনটি অংশে বিভক্ত হয়ে এগিয়ে চলছে রেলপথ নির্মাণকাজ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মাটি ভরাটসহ সব স্থানেই নির্মিত হয়েছে রেলওয়ে ব্রিজ। এছাড়া দৃশ্যমান হয়েছে মাওয়া স্টেশনের কাজও। ঢাকা-মাওয়া অংশের অগ্রগতি ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া মাওয়া-ভাঙ্গা ৭৭ ও ভাঙ্গা থেকে যশোরের অগ্রগতি ৪৬ শতাংশ।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক (ওয়ে অ্যান্ড ওয়ার্ক) আবু ইউসুফ মোহাম্মদ শামীম বলেন, প্রকল্পের আওতায় ১৭২ কিলোমিটার মেইন লাইন নির্মাণ করা হবে। এই রেলপথে প্রায় ২৩ কিলোমিটারের বেশি উড়ালপথ নির্মিত হবে। উড়ালপথ নির্মাণ ব্যয়বহুল। তারপরও নানা কারণে উড়ালপথ নির্মাণ ছাড়া কোনো পথ নেই। যেমন- প্রকল্প এলাকায় ঢাকা-বুড়িগঙ্গা-কেরানীগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জ এলাকায় নিচু জমি। এসব কারণেই উড়াল সড়ক নির্মিত হবে। উড়ালপথ হবে ব্যালাস্টলেস।
লেভেল ক্রসিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই পথে লেভেল ক্রসিং থাকবে না। সেজন্য কোথাও রেলওয়ে ওভারপাস কোথাও আবার আন্ডারপাস নির্মাণ করা হবে। এছাড়া বুড়িগঙ্গা ও মধুমতিসহ বেশকিছু নদীতে রেলসেতু নির্মাণ করা হবে। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে রেলপথের কাজ।
জানা যায়, প্রকল্পের মোট ব্যয় ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে চায়না ঋণ ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৬৯ লাখ এবং সরকারি অর্থায়ন ১৮ হাজার ২১০ কোটি টাকা। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের জানুয়ারি মাসে। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সব কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা।
সূত্র: জাগো নিউজ