জীবন বাজি রেখে ৭ মার্চের ভাষণের রেকর্ড সংরক্ষণ করেছিলেন যে মানুষটি

ফানাম নিউজ
  ০৭ মার্চ ২০২২, ১০:০০

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ। সেই ঐতিহাসিক ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই একটি ভাষণই তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষকে মুক্তি পথ দেখায়, স্বাধীন হতে অনুপ্রেরণা জোগায়।

৭ই মার্চের সেই ভাষণ সংরক্ষণ করা খুব সহজ ছিল না। ছিল নিজের জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা। তবুও সেই শঙ্কা উপেক্ষা করে বাঙালি জাতির জন্য শ্রেষ্ঠ ভাষণটি রেকর্ড ও সংরক্ষণ করেন কয়েকজন। তাদের মধ্যে একজন হলেন সাভারের আমজাদ আলী খন্দকার। যিনি এ বছর মুক্তিযুদ্ধ ক্যাটাগরিতে একুশে পদক পেয়েছেন। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র বিভাগের সহকারী ক্যামেরাম্যান।

সেদিনের সেই ঘটনা জানতে সাভার পৌর এলাকার মধ্য গেন্ডা মহল্লার ব্লক এ, ৮৩ নম্বর ‘খন্দকার ভিলা’ নামে আমজাদ আলী খন্দকারের বাড়িতে যায় গনমাধ্যমকর্মীরা। বয়স্ক এ মানুষটি হাতে লাঠি নিয়ে খোলা আকাশের নিচে চেয়ার পেতে বসেন।

শুরুতেই জানাচ্ছিলেন তার অসুস্থতার কথা। কয়েক মাস আগে তিনি স্ট্রোক করেন। এসময় প্রতিবেদক বঙ্গবন্ধুর কথা তুলতেই তিনি তাকেও বসার ব্যবস্থা করে দেন। কথাও বলেন গুণী এ মানুষটি।

প্রথমে ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে জানতেই চাইলে আমজাদ আলী খন্দকার বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা কয়েকজন ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রেকর্ড করি। রেকর্ড শেষে ওই রাতেই ভাষণের রেকর্ড করা ফিল্ম অফিসে রাখি। সেসময় অফিসে কোনো ল্যাব না থাকায় এফডিসি থেকে ফিল্ম প্রিন্ট করে আনা হতো। তখন বঙ্গবন্ধুর নামে কোথাও কোনো কিছু বের করা যেত না। কৌশলে ‘সাইক্লোন’ বা ‘নির্বাচন’ লিখে গোপনে এফডিসি থেকে ভিডিও প্রিন্ট করে এনে তাতে চিহ্ন দিয়ে রাখা হতো। কোনটাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভিডিও আছে তা আমরা দেখেই বলে দিতে পারতাম।

তিনি আরো বলেন, ২৫ মার্চ পাকিস্তানিরা আক্রমণের পর ৯ এপ্রিল পরিচালক খায়ের সাহেব আমাকে ডাকেন। আমি এলে তিনি আমাকে সদরঘাট থেকে আনা কালো রঙের ৪২ ইঞ্চির একটি ট্রাঙ্ক (বাক্স) দিয়ে ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে বলেন। সেই ট্রাঙ্কে ছিল বঙ্গবন্ধুর কিছু ছবি ও ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিও ক্যাসেট।

সাহস করে পরিচালকের রুম থেকে বিদায় নিয়ে সচিবালয়ের দ্বিতীয় গেট দিয়ে এক বাঙালি অফিসারের সাহায্যে বের হই। নিজের জীবন বাজি রেখে পাক সেনাবাহিনীর সামনে দিয়েই সোয়ারীঘাটে পৌঁছাই। ট্রাঙ্কটি নিয়ে নদী পার হই। এরপর জিনজিরা বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি বাসের ছাদে উঠে বক্সগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নামি।

সেখানে কোনো যানবাহন না থাকায় একটি ঘোড়ার পিঠে ট্রাঙ্ক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে দোহার থানার জয়পাড়া গ্রামের মজিদ দারোগার বাড়িতে নিয়ে ট্রাঙ্কটি রাখি। এরইমধ্যে দোহার থানায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পৌঁছে যাওয়ায় নিরাপত্তার জন্য দোহার থেকে আরো ভেতরে চরকোষা গ্রামের অমেদ খাঁ এবং দানেশ খাঁ নামে দুই ভাইয়ের বাড়ির বড় ধানের গোলার ভেতরে ট্রাঙ্কটি লুকিয়ে রাখি।

পরের দিন খায়ের সাহেব ভারতে গিয়ে ভারতীয় হাইকমিশন এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে সেই ধানের গোলা থেকে ট্রাঙ্কটি নিয়ে মুক্তিবাহিনীর মাধ্যমে ভারতে পাঠিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিও ক্যাসেট ভারতেই ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর খায়ের সাহেব দেশে ফিরে আসার সময় বঙ্গবন্ধুর সেই ৭ মার্চের ভাষণও সঙ্গে নিয়ে আসেন।

আমজাদ আলী খন্দকার সেদিন ভাষণটি সংরক্ষণ করতে পারলেও পারেননি মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের স্বীকৃতি পেতে। অনেকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে অভিমান নিয়ে বসে ছিলেন। দীর্ঘ ২১ বছর বিটিভিতে কাজ করে এখন তিনি অবসরে। জীবনের শেষ সময়ে এসে এবার একুশে পদক পেয়েছেন এই গুণী মানুষটি। এতে তার কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়েছে।

সূত্র: জাগো নিউজ