শিরোনাম
কোনো পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর পর পাঁচ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান পেতো পরিবার। তখন বিল পাস করতেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি)। সরকার ২০২০ সালে অনুদান পাঁচ লাখ টাকা থেকে আট লাখ করার পর সেই বিল পাস করেন জেলা প্রশাসকরা। এতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে। ২০২০ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় মারা যান ৩৭৭ পুলিশ সদস্য। এরমধ্যে মাত্র ৭৯ পরিবার অনুদানের টাকা পেয়েছেন। বাকি সব সদস্যের টাকা পেন্ডিং রয়েছে।
মঙ্গলবার (১ মার্চ) দুপুরে রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বরে পুলিশ স্টাফ কলেজ (পিএসসি) কনভেনশন হলে ‘পুলিশ মেমোরিয়াল ডে’র অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ।
অনুষ্ঠানে আইজিপির সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন।
আইজিপি স্বরাষ্ট্র সচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আমাদের পুলিশের কোনো সদস্য যখন দায়িত্বরত অবস্থায় মারা যায় তখন পুরো পরিবার অথৈ সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়। জেলা প্রশাসকরা অনেক ব্যস্ত থাকেন। এই দায়িত্ব যদি আবারও পুলিশ সুপারদের কাছে যায় তাহলে সমন্বয়হীনতা থাকবে না। মৃত পুলিশ সদস্যদের অসহায় পরিবারগুলোর অনেক উপকার হবে। আশা করছি এই অনিশ্চয়তা কাটাতে উদ্যোগী হবে মন্ত্রণালয়।
‘পুলিশ মেমোরিয়াল ডে’ উপলক্ষে ২০২১ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের প্রতি সম্মান জানিয়ে পুলিশ মেমোরিয়ালে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও তাদের পরিবারবর্গকে স্বীকৃতি স্মারক প্রদান অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে একথা বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে আইজিপি বলেন, শান্তিকালীন সময়ে যারা দুষ্কৃতকারী, জনগণ, সমাজ ও রাষ্ট্র ধ্বংসের জন্য লিপ্ত হয় তাদের বিরুদ্ধেই পুলিশই ক্রমাগত যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। এই যুদ্ধ সন্ত্রাসী, অপরাধী, জঙ্গি, গ্যাং, চোর-ডাকাতদের বিরুদ্ধে। যারা শান্তিভঙ্গ কিংবা বিনষ্ট করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ থাকলে মৃত্যু অনিবার্য। আমরা শান্তিকালীন সময়ে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছি দেশ, জনগণ, সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য। এজন্য আত্মত্যাগ করছে পুলিশ সদস্যরা।
আইজিপি আরও বলেন, পুলিশ ডিউটিতে প্রাণ হারায়। আমরাও প্রতিবছর শত শত সহকর্মীকে হারাই কর্তব্যরত অবস্থায়। ৩৪৬ জন পুলিশ সদস্যকে হারিয়েছি গত বছর। এরমধ্যে শুরু করোনার দুই বছরে আমরা ১০৬ জন পুলিশ সদস্যকে হারিয়েছি। আজ ১৩৮ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে।
পুলিশ সদস্যদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কমরেড, সহকর্মী, বন্ধু, কলিগ ও প্রিয়মুখকে হারিয়েছি জানিয়ে পুলিশ প্রধান বলেন, শুধু সমবেদনা জানানোয় এটা সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের বিরাট অনুরণন আছে, শোকাবহ অনুরণন রয়েছে। আমরা তাদের আত্মত্যাগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কারণ আমরা বীরের জাতি। বীরের আত্মত্যাগ আরও বীরের জন্ম দেবে। কেউ আহত হন, নিহত হন ও মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস তাদের অবদানকে সর্বদা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছে।
তিনি বলেন, আমাদের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রফেশনাল, জব সেফটি, সেফটি এনভায়রনমেন্ট আরও ভালো করার চেষ্টা করছি। যারা অসুস্থ হোন তাদের আর্থিকভাবে সহায়তা করে থাকি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদেই পুলিশ কল্যাণ ট্রাস্টের যাত্রা শুরু হয়। তিনি ৫ কোটি টাকার চেক দিয়ে এর যাত্রা শুরু করেছেন। এখন পর্যন্ত ২০০৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৭ বছরে ৫২ কোটি টাকা দিয়েছি। এ বছরও পৌনে দুই কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে চিকিৎসার জন্য।
আইজিপি আরও বলেন, গত দুই বছরে সবার সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালে পরিণত হয়েছে আমাদের কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরও বেশি সহযোগিতা-সাপোর্ট প্রত্যাশা করছি।
বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব ও কাজের পরিবেশের কারণে পুলিশ সদস্যদের বিশেষ ধরনের রোগ হচ্ছে জানিয়ে ড. বেনজীর আহমেদ বলেন, শ্বাসকষ্ট, কিডনি রোগ, ক্যান্সার ও হার্টের সমস্যা হচ্ছে। আমরা এরইমধ্যে ডালাইসিস ইউনিট যুক্ত করেছি। যেখানে ১০০ থেকে ১৫০ কিডনি রোগে আক্রান্ত পুলিশ সদস্য ডায়ালাইসিস সুবিধা পাচ্ছেন। এসব রোগের চিকিৎসা আমাদের হাসপাতালে চলছে। ২৯৬ জন স্টাফ দিয়েছে সরকার। এর নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। এটা সম্পূর্ণ হলে চিকিৎসার মান আরও বাড়বে।
তিনি বলেন, আমরা চলতি বছরই ক্যাথ ল্যাব (কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন) সংযুক্ত করছি। এরফলে হার্টের রোগীদের আর বাইরে যাওয়া লাগবে না। ইন হাউজ রিং পড়ানো যাবে।
আগামী বছরই ক্যান্সার ইউনিট চালু করা হবে জানিয়ে পুলিশ প্রধান বলেন, এরইমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। সিরিয়াস ব্যাধির চিকিৎসা হবে। ক্যান্সার হলে ৫, ১০ ও ১৫ লাখে কিছু হয় না। এই টাকা খরচ না করে আমরা চিকিৎসার সার্বিক ব্যবস্থা করবো। ঢাকা বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এটি সম্পন্ন হলে কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চাপ কমবে। ২ লাখ ১২ হাজার সদস্যের চিকিৎসা সম্ভব হবে আমাদের হাসপাতালেই। আড়াইশ’ বেডের এই হাসপাতাল এখন ১১৫০ বেডের। সেখানে আরও ৫০০ বেড বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
তিনি বলেন, পুলিশ বহুমুখী দায়িত্ব পালন করে। রাষ্ট্র ব্যবস্থার যে উন্নতি তাতে শিল্পায়ন নগরায়ন হচ্ছে। আর্থিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকছে বছরের পর বছর কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না। মানুষ একা হয়ে পড়ছে। সে কারণেই বর্তমান অবস্থার মধ্যে এমন কোনো ক্ষেত্র নাই যেটা পুলিশের দায়িত্বের বাইরে। উন্নয়নের পেছনে আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজ করি। শিল্প পুলিশ প্রতিষ্ঠার আগে এমন কোনো মাস ছিল যে আগুন লাগেনি। এখন কিন্তু মালিক বেতন না দিলে শিল্প পুলিশ সে ব্যবস্থা করছে।
আইজিপি আরও বলেন, পাঁচটা মন্ত্রণালয় আমরা সিলেক্ট করেছি, যারা আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি। রাষ্ট্র উপকৃত হবে। যদিও কারও কারও চক্ষুশূলের কারণ হচ্ছি। গ্রাম পর্যায়ে পুলিশিং এর সঙ্গে উন্নয়নের কাজে অংশ নিতে পারি।
পুলিশ স্টাফ কলেজ (পিএসসি) কনভেনশন হলে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে ২০২১ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী ১৩৭ পুলিশ সদস্যদের পরিবারকে স্বীকৃতি স্মারক প্রদান করা হয়।
এর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, আইজিপি'সহ উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা ২০২১ সালে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের পরিবার পুলিশ স্টাফ কলেজ চত্বরে নবনির্মিত পুলিশ মেমোরিয়ালে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
১৯৯৩ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে এবং কর্মরত অবস্থায় নিহত পুলিশ সদস্যদের সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পুলিশ ২০১৭ সাল থেকে ১ মার্চ মেমোরিয়াল ডে পালন করছে।
প্রতি বছর মেমোরিয়াল-ডে তে ওই বছরে মৃত পুলিশ সদস্যদের পরিবারের উপস্থিতিতে সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
মেমেরিয়াল-ডে পালন করার জন্য এরইমধ্যে রেপলিকা তৈরি করা হয়েছে। জেলা/ইউনিটে একই দিনে রেপলিকা-স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করে মেমেরিয়াল-ডে পালন করা হচ্ছে।
বিভিন্ন দেশের বিদ্যমান স্মৃতিস্তম্ভ পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ পুলিশ ২০১০ সালে স্থায়ী দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিজ্ঞ নির্মাণ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় নকশা প্রণয়ন ও সাইট নির্ধারণ করে ২০১৯ সালে নির্মাণ কাজ আরম্ভ করা হয়।
বেদীর মাঝখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরের সম্মুখযোদ্ধা রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের পুলিশ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের বছর ১৯৭১ এর অনুসরণে টাওয়ারটির উচ্চতা ৭১ ফুট নির্ধারণ করা হয়েছে। রাতের বেলায় টাওয়ার থেকে বিকিরিত আলো বীর শহীদদের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে।
সূত্র: জাগো নিউজ