শিরোনাম
গরমে খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিত অনেকেরই জানা নেই। সময় উপযোগী খাবার না খাওয়ার ফলে নানা সমস্যা দেখা দেয়। তাই জানা উচিত কী খাবেন ও কী খাওয়া উচিত।
পুষ্টিবিদ ও ডাক্তারদের মতামত জানালেন মোহসীনা লাইজু-
সুস্থ থাকবেন যেভাবে
গরমের এই পরিস্থিতিতে সবারই স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া উচিত। এ সময় তাপ ব্যবস্থাপনা জানা থাকলে ভালো। মানুষের শরীরে অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে। তাপমাত্রা বাতাসের আর্দ্রতা পরিমাণের থেকে বেশি হলে শরীর সহ্য করতে পারে না। অস্বস্তিসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়। তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে হিট স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। পানিশূন্যতা রোধে প্রচুর পানি ও পানীয় খাবার গ্রহণ করতে হয়। পানি, স্যালাইন, ফলমূলের রস, শরবত ও ডাব ইত্যাদি শরীরে প্রয়োজনীয় আর্দ্রতা জোগায়। পানিজাতীয় সবজি-ফলমূল খাওয়া যেতে পারে। বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সূর্যের তাপমাত্রা বেশি থাকে। তখন সরাসরি রোদে না যাওয়া এবং অতিরিক্ত পরিশ্রমের কাজ থেকে বিরত থাকা ভালো। গেলেও ছাতা, টুপি, স্কার্ফ ও সানগ্লাস এবং সঙ্গে পানির বোতল রাখুন। প্রচণ্ড গরমে ভাজা-পোড়া বা জাংক ফুড না খাওয়া । এ ধরনের খাবার শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি বদহজমের আশঙ্কাও থাকে। ঘর ঠা-া রাখার জন্য ঘরে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা করা। ঘরের ভেতর ইনডোর প্ল্যান রাখা। গাছ তাপ শুষে নেবে। ঘরে আলো কমিয়ে রাখলে ঘর ঠা-া থাকবে।
যেমন খাবার দরকার
প্রচণ্ড গরম শুধু অস্বস্তিরই কারণ না, সঙ্গে এনার্জি লেভেলও কমায়। তাই সঠিক খাদ্যাভ্যাস খুবই জরুরি। যতই তৃষ্ণার্ত থাকুন না কেন বাইরের খোলা জায়গার পানি, শরবত, আখের রস খাবেন না। এর থেকে ডায়রিয়া, আমাশয় ও জন্ডিস হতে পারে। গরমে মাছ, মাংস, ভুনা, ভাজি, খিচুড়ি, পোলাও কমিয়ে পাতলা ডাল, পাতলা দুধ, টকদই, করলা, লেবু চিনির শরবত, সালাদ, রসালো ফল খাবেন। গরমে সকালে না হেঁটে বিকেল বা সন্ধ্যার পর হাঁটা আরামদায়ক। বেশি হাঁটা, ব্যায়াম, অধিক পরিশ্রম ও খাওয়া খুব ঝুঁকিপূর্ণ। অতিরিক্ত মসলাদার যেকোনো খাবারই দেহের তাপমাত্রা বাড়ায় এবং বিপাকক্রিয়া ব্যাহত করে। গরমে তন্দুরি, মসলাদার মাংস স্বাস্থ্যকর নয়। এমনকি সামুদ্রিক মাছ হলেও বাদ দেওয়া ভালো। কারণ অতিরিক্ত আমিষজাতীয় খাবার দেহ উত্তপ্ত , ঘাম বেশি এবং খাবার হজমে সমস্যা করে। চা বা কফিজাতীয় পানীয় দেহে তাপ ও পানিশূন্যতা বাড়ায় এবং মুখ ফ্যাকাশে করে ফেলে। সস দিয়ে তৈরি খাবার বা শুধু সস খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত নয়। সসে অতিরিক্ত মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট এবং লবণ থাকে। যা শরীর ক্লান্ত করে দেয়।
অ্যাসিডিটি বাড়তে পারে
খাবার চিবিয়ে না খেলে হজম করতে অসুবিধা হয়। খাবার চিবোলে তাতে নানা উৎসেচক যোগ হয়ে তাকে সহজপাচ্য করে তোলে। পেটের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। পানিশূন্যতা রোধে খাদ্যতালিকায় ডিটক্স ওয়াটারও রাখতে পারেন। মাংস খেয়েই দুধ বা দুগ্ধজাত কোনো খাবার, ভাতের পরেই ফল, ভাজাভুজি খেয়েই পানি খাবেন না। এসব পরপর না খেয়ে একটু সময় রাখুন মধ্যখানে। প্রক্রিয়াজাত খাবারে অনেক রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। এসব প্রক্রিয়াজাত খাবারের কারণে হজমের সমস্যার পাশাপাশি পরিপাকতন্ত্র তার কর্মক্ষমতা হারায়। এ ধরনের খাবার এড়িয়ে চলুন।
রোগব্যাধি
পানিশূন্যতা : গরমে যে পরিমাণ পানি পান করা হয় তার চেয়ে বেশি পরিমাণ পানি শরীর থেকে বের হলে ডিহাইড্রেশন হতে পারে। ডিহাইড্রেশন দূর করতে পানির পাশাপাশি ফলের রস, লেবুর শরবত, স্যালাইন, ডাবের পানি খেতে পারেন। ডিহাইড্রেশনে সব ধরনের তরল খাওয়া যাবে না। চা, কফি বা ক্যাফেইনজাতীয় তরল, উচ্চ লবণ এবং উচ্চ প্রোটিনজাতীয় খাবার থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এসব তৃষ্ণাও শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
হাইপারথার্মিয়া : হাইপারথার্মিয়া হলো দেহের অস্বাভাবিক উচ্চ তাপমাত্রা। এমন অবস্থায় শরীর পরিবেশ থেকে আগত তাপ এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়। হিট স্ট্রোক, হিট ক্যাম্প, হিট এক্সোশন ইত্যাদি হাইপারথার্মিয়ার বিভিন্ন স্টেজ। গরমের দিনে এর ঝুঁকি বাড়ে। হাইপারথার্মিয়া হলে প্রচুর পানি ও তরল খাবার তেঁতুলের শরবত, আখের রস, ডাবের পানি, কাঁচা আমের শরবত ইত্যাদি খেতে হবে। দেহের ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্স ঠিক রাখতে সোডিয়াম ও পটাশিয়াম-সমৃদ্ধ খাবার যেমন মিষ্টি আলু, পালংশাক, আলু, টমেটো, বিট, কমলা লেবু, পেস্তা, কিশমিশ প্রভৃতি খাবার খাওয়া দরকার।
হিট স্ট্রোক : অতিরিক্ত গরম ও পানিশূন্যতার কারণে হিট স্ট্রোক হয়। শরীরের তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে গেলে এবং ঘাম বা অন্য উপায়ে তাপ কমানো না গেলে এবং শরীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে হিট স্ট্রোক হয়। হিট স্ট্রোকে দেহের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হয়ে যায়। প্রথমেই রোগীর শরীর ঠাণ্ডা করতে হবে। প্রচুর পানি এবং তরল খাবার খাওয়া। তেঁতুলের শরবত, আখের রস, ডাবের পানি, কাঁচা আমের শরবত পান করা ভালো। ডাবের পানি শরীরের ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্স ঠিক রাখে।
ঘামাচি : ঘামাচির অন্যতম কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত ঘামানো। ঘামাচি দূর করতে ঘামাচি পাউডার ও ঘরোয়া উপায় অনুসরণ করতে পারেন। ওমেগা-৩-সমৃদ্ধ খাবার বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ, ইলিশ, রূপচাঁদা, বাদাম, মাছের ডিম খেতে পারেন। ভিটামিন-ই ও সি-সমৃদ্ধ খাবার তাপের প্রতিক্রিয়া পরিচালনা বা হ্রাস করতে সহায়তা করে। এ ছাড়া আপেল, গাজর, পালংশাক, ব্রোকলি, কুমড়ো, তরমুজ, আম, পেঁপে, ডুমুর, বিটরুট ইত্যাদি উপকারী খাবার। লিভার পরিষ্কার ও ত্বকের নিরাময়ে সহায়তা করে।
জলবসন্ত : গরমে জলবসন্তে আক্রান্তের হার বেশি থাকে। জলবসন্ত হলে হালকা ধরনের খাবার খাওয়া উচিত। নরম, ঠা-া, প্রচুর পানি এবং অ্যাসিডিক নয় এমন ফল ও সবজি যেমন : আলু সেদ্ধ, মিষ্টি আলু, কলা, তরমুজ, বেরি, ব্রোকলি, শসা, পালংশাক, দই, ডাবের পানি, ফলের রস ইত্যাদি খেতে হবে। অতিরিক্ত ক্যালরি, ভিটামিন ও মিনারেল-সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া প্রয়োজন। আয়রন-সমৃদ্ধ খাবার চিকেন পক্সের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারে। জলবসন্তে মসলাদার, নোনতা, অ্যাসিডিক এবং ক্রাঞ্চি খাবার এড়ানো উচিত।
টাইফয়েড : অনিরাপদ পানি ও অস্বাস্থ্যকর খাবার টাইফয়েডের জীবাণু ছড়ায়। তাই হাইড্রেটেড থাকতে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। উচ্চ ফাইবারজাতীয় খাবার টাইফয়েড জ্বরে হজমের সমস্যা করতে পারে। কম ফাইবারযুক্ত খাবার খেতে হবে। রান্না করা নরম শাকসবজি উপকার। পাকা কলা, বাঙ্গি, সাদা ভাত, পাস্তা, সাদা রুটি, ডিম, দই, মুরগি, টার্কি, মাছ ইত্যাদি টাইফয়েড জ্বরের সময় ভালো খাবার। সয়াবিন, বাদাম, বীজ এবং ডিমজাতীয় খাবার ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড-সমৃদ্ধ। এসব খাবার টাইফয়েড আক্রান্ত রোগীদের জন্য উপকার, কারণ দেহে প্রদাহ কমায়। হাই-ক্যালরি এবং কার্বোহাইড্রেট-জাতীয় খাবার দেহে শক্তি জোগায়।
ফুড পয়জনিং : দূষিত খাবার ও দূষিত পানি হজমে সমস্যা করে। এটাই ফুড পয়জনিং। স্যালাইন বা তরল খাবার বেশি খেতে হবে। কলায় প্রচুর পটাশিয়াম আছে, যা শরীরের ইলেকট্রোলাইট প্রতিস্থাপনে সহায়তা করে। টক দই হজমে সাহায্য করে। ফুড পয়জনিং হলে দুগ্ধজাত খাবার, চা, কফি বা ক্যাফেইন জাতীয় খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। খাদ্যতালিকায় ফাইবার, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিনযুক্ত খাবার রাখুন। বেশি করে সবুজ সবজি, টমেটো, তরমুজ, শসা, আনারস, মিষ্টি আলু এবং সালাদ খেলে পেট সুস্থ থাকবে।
শরীর জুড়ানো খাবার
সকালের নাশতা বা দুপুরের খাবারের তালিকায় কম তেল-মসলার রান্না সবজি রাখতে পারেন। রাতে কম তেল-মসলার সবজির স্যুপ, চিকেন স্যুপ খেতে পারেন। দুপুরের খাবারের সঙ্গে বা বিকেলের নাশতায় সালাদ রাখুন। শসা, পুদিনাপাতা শরীর ঠা-া রাখতে সাহায্য করে। শসার সালাদে টক দই ব্যবহার করতে পারেন। রাতের খাবারের পর টক দই খাওয়া ভালো। সকালে রুটি সবজির পরিবর্তে দই, চিড়া, কলা খেলে আরাম পাবেন। গরমে খিচুড়ি, তেলে ভাজা পরোটা, পোলাও, বিরিয়ানির পরিবর্তে সাদা ভাত খাওয়া ভালো। সঙ্গে পাতলা ডাল, মাছ বা মাংসের সঙ্গে সবজি দিয়ে রান্না করা পাতলা ঝোল ও সালাদকে প্রাধান্য দিন।