শিরোনাম
প্রচন্ড আঘাত থেকে অনেক সময় মানসিক বিপর্যয় ঘটে। এ অবস্থা থেকেও মানুষ ফিরে আসে। তবে সঠিক চিকিৎসা ও সেবা দরকার হয়।
এ বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতারের সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি) ডা. সাইফুন্ নাহার।
তীব্র মানসিক চাপ তৈরি করার মতো ঘটনা যেমন; বন্যা, ভূমিকম্প, ভবনধস, বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড, যে কোনো পরিবহনের মারাত্মক দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞ, যুদ্ধ, প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতন ইত্যাদি থেকে এ রোগের সৃষ্টি হয়। সরাসরি দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ছাড়াও যারা দুর্ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেন অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়, ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উদ্ধারকর্মী, চিকিৎসক এদের মাঝেও এ রোগ দেখা দিতে পারে।
সাধারণত গুরুতর মানসিক আঘাত পাওয়ার কয়েক মিনিট বা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তীব্র মানসিক চাপের লক্ষণগুলো দেখা দেয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ৪৮-৭২ ঘণ্টার মাঝেই সেগুলো কমতে থাকে এবং ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে একেবারে কমে যায়। তখন এ সমস্যাটিকে একিউট স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (ASD) বলা হয়। অর্থাৎ মানসিক আঘাত পাওয়ার ১ মাসের মধ্যে যে কোনো সময় শুরু হয়ে লক্ষণগুলো যদি ১ মাসের মধ্যেই কমে যায় তখন এটি অঝউ। মানসিক আঘাত থেকে সৃষ্ট মানসিক চাপের লক্ষণগুলো যদি এক মাসের বেশি সময় ধরে বিদ্যমান থাকে তবে সেটিকে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি) বলা হয়। সাধারণত মানসিক আঘাত পাওয়ার প্রথম তিন মাসের মধ্যেই এটি দেখা দেয়। মানসিক আঘাতের কয়েক বছর পরেও শুরু হতে পারে। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই অথবা মূল দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এমন কোনো শব্দ, ছবি, কথা বা বর্ণ দ্বারা উদ্দীপিত হওয়ার পর লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে পারে।
একই ঘটনা সবার মাঝে সমান তীব্রতার মানসিক চাপ তৈরি করে না বা এই রোগ তৈরি করে না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধ এদের মাঝে, যাদের আগে মানসিক চাপের ইতিহাস থাকে, যাদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা কম থাকে, যাদের আগে বিষণ্ণতা, উদ্বেগজনিত রোগের ইতিহাস থাকে, যাদের সামাজিক সহায়তা কম থাকে, বুদ্ধিবৃত্তি কম থাকে এবং যাদের বংশে এই রোগের ইতিহাস থাকে তাদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
প্রতিটি মানুষের স্নায়ুতন্ত্র এবং চাপ সহ্য করার ক্ষমতা কিছুটা ভিন্ন হওয়ার কারণে মানসিক আঘাত পরবর্তী মানসিক রোগের লক্ষণগুলোও কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। মূলত চার ধরনের লক্ষণ দেখা যায়।
দুর্ঘটনার পুনঃঅভিজ্ঞতা (re-experiencing of aspects of the stressful events)
* বারবার দুর্ঘটনার অস্বস্তিকর, কষ্টদায়ক স্মৃতি মনে পড়া
* ফ্ল্যাশব্যাক (তীব্র মানসিক চাপ রোগীর মানসিক অবস্থাকে এতটাই বিপর্যস্ত করে যে তার কাছে ঘটনার সময়ের অনুভূতি খুব জীবন্ত মনে হয়, মনে হয় ঘটনাটি আবারও ঘটছে, তাই ঘটনার সময় যেমন আচরণ করেছিল সে রকম আচরণ করতে থাকে)
* মূল ঘটনাটি নিয়ে অথবা অন্য কোনো ভয়ঙ্কর বিষয়ে দুঃস্বপ্ন দেখা
* দুর্ঘনার কথা মনে হলে তীব্র শারীরিক প্রতিক্রয়া তৈরি হওয়া (যেমন; বুক ধড়ফড় করা, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হওয়া, বমিভাব, ঘাম দেয়া, মাংসপেশীতে টান অনুভব করা )
এড়িয়ে চলা (avoidance of reminders) এবং স্তব্ধ হয়ে যাওয়া (numbness)
* দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয় এমন আলাপচারিতা, ব্যক্তি, বস্তু, কাজ, স্থান, চিন্তা, অনুভূতিকে এড়িয়ে চলা
* দুর্ঘটনার খণ্ডচিত্র স্মৃতিতে ধারণ করা এবং দুর্ঘটনার অনেক বিষয় মনে করতে না পারা
* জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
* অন্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করা
* ভবিষৎকে ছোট করে দেখা (স্বাভাবিক জীবনযাপনে অনাগ্রহ, বিয়ে না করা, চাকরি না করা)
অত্যধিক সচকিত থাকা (hyperarousal)
* ঘুমের সমস্যা
* খিটখিটে মেজাজ, রেগে যাওয়া
* অল্পতেই চমকে ওঠা
* সদা সতর্ক থাকা
* আগ্রাসী মনোভাব, বেপরোয়া আচরণ, নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা
* নেতিবাচক চিন্তা এবং আবেগীয় পরিবর্তন
* অপরাধবোধে ভোগা বা নিজেকে দোষী ভাবা, লাঞ্ছিত বোধ করা
* একা বা বিচ্ছিন্নবোধ করা
* বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, প্রতারিত বোধ করা
* মনোযোগে সমস্যা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া
* হতাশা, নৈরাশ্য দেখা দেয়া
শিশুদের লক্ষণগুলো প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে ভিন্ন হতে পারে। যেমন-
* পিতামাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয়
* আগের শেখা কাজগুলো ভুলে যাওয়া (যেমন : টয়লেট ট্রেইনিং)
* ঘুমের সমস্যা, দুঃস্বপ্ন দেখা
* দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয় এমন নতুন কিছুর প্রতি ভয় তৈরি হওয়া (রাক্ষসের ভয়)
* খেলা, ছবি আঁকা বা গল্প বলার মধ্য দিয়ে দুর্ঘটনার বিষয় প্রকাশ করা
* কোনো কারণ ছাড়াই শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা, বেদনা অনুভব করা
* খিটখিটে মেজাজ, আগ্রাসী আচরণ করা
চিকিৎসা
মানসিক চাপের লক্ষণ, কারণ, সময়কাল, তীব্রতা ও অতীতে মানসিক আঘাত পাওয়ার ইতিহাস, বংশগত ইতিহাস, পূর্বে মানসিক রোগের ইতিহাস, শারীরিক রোগের ইতিহাস, মানসিক এবং শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিশদ মূল্যায়নের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়। তারপর, আক্রান্ত ব্যক্তির বিশেষ প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা পরিকল্পনা করা হয়। চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হচ্ছে-
* লক্ষণগুলো কমানো
* সমস্যাগুলো মোকাবেলায় দক্ষ হতে প্রশিক্ষণ প্রদান
* আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা
* সাইকোথেরাপি অথবা ওষুধ অথবা উভয়ের সমন্বয়ে মূল চিকিৎসা করা হয়। যেহেতু মানসিক আঘাতের কারণ, ব্যক্তিবিশেষের অভিজ্ঞতা এবং পরিণতি ভিন্ন হয় সেহেতু রোগের লক্ষণ এবং রোগীর প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসাপদ্ধতিও কিছুটা ভিন্ন হতে পারে
* সাইকোথেরাপির মাঝে ট্রমা ফোকাসড কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি (কগনিটিভ প্রসেসিং থেরাপি, প্রোলং এক্সপোজার থেরাপি), ইএমডিআর (আই মুভমেন্ট ডিসেনসিটাইজেশন অ্যান্ড রিপ্রসেসিং) বেশ কার্যকর
* কগনিটিভ প্রসেসিং থেরাপি- এর মাধ্যমে দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিজের এবং অন্যদের সম্পর্কে রোগীর নেতিবাচক চিন্তা- যেগুলো তার আচরণকে প্রভাবিত করছে এবং দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করছে সেগুলোকে শনাক্তকরণ ও সংশোধন করা হয়। এটি প্রতি সপ্তাহে ৬০-৯০ মিনিট করে মোট ১২ সপ্তাহ ধরে দিতে হয়।
* প্রোলং এক্সপোজার থেরাপি- রোগীর সঙ্গে কথা বলে তার মানসিক আঘাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানা হয় এবং তার ভয়ের উৎস খুঁজে বের করা হয়। তারপর তাকে ধাপে ধাপে ভয়ের উৎসগুলোকে মোকাবেলা করে ভয়কে জয় করতে শেখানো হয়।
এছাড়া প্রগ্রেসিভ মাসকিউলার রিলাক্সেশন, ব্রিদিং রিলাক্সেশন ইত্যাদি ব্যায়াম খুব কার্যকর।
ওষুধের মাঝে সিলেকটিভ সেরোটোনিন রিআপটেক ইনিহবিটর্স (SSRI), পিটিএসডি এর চিকিৎসায় কার্যকর। এর মাঝে সারট্রালিন এবং পেরোক্সেটিন এফডিএ (FDA-U.S) অনুমোদিত। এগুলো পিটিএসডি রোগীর বিষণ্ণতা, উদ্বেগ, রাগ ইত্যাদি কমাতে সাহায্য করে। তাছাড়া রোগীর নিদ্রাহীনতা, অস্থিরতা, সন্দেহপ্রবণতা ইত্যাদি কমাতে কিছু এন্টিসাইকোটিক (যেমন ওল্যানযেপাইন, কিউটিয়াপাইন, রিসপেরিডোন) ইত্যাদি কার্যকর। ঘুমের সমস্যা দূর করতে এবং রোগীকে প্রশান্ত করতে বেন্জোডায়াজেপাইন ব্যবহার করা যায় তবে সেগুলোতে নির্ভরশীল হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
সাইকোথেরাপি শুরু করার আগে অথবা চলাকালীন সময়ে ওষুধ গ্রহণ করলে চিকিৎসা বেশি কার্যকর হয়।
রোগী/দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিকে সংকটাবস্থা থেকে নিরাপদ অবস্থায় আনার পর পিটিএসডি-এর সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা শুরু করা উচিত। মাদকাসক্তি, বিষণ্ণতা, আত্মহত্যার প্রবণতা, প্যানিক ডিসঅর্ডার ইত্যাদি থাকলে গুরুত্ব দিয়ে সেগুলোর চিকিৎসা করতে হবে।
চিকিৎসা প্রদানের সময় যে বিষয়ে সতর্ক হতে হবে সেগুলো হল-
* রোগীর কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা জানাতে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা যাবে না
* রোগীর প্রতি সহমর্মী হতে হবে, তাদের অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে
* সর্ব প্রকার গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে
* এমন কোনো কথা বলা বা কাজ করা যাবে না যাতে রোগী আবার আঘাত (retraumatized) পায়।
সূত্র: যুগান্তর