শিল্পকলায় দুর্নীতি: ২৬ কোটি টাকা কোথায়?

ফানাম নিউজ
  ০৪ অক্টোবর ২০২১, ১১:০১
আপডেট  : ০৪ অক্টোবর ২০২১, ১১:১৫

শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক (ডিজি) লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে অনিয়ম করে নানা প্রয়োজন দেখিয়ে সরকারের ২৬ কোটি টাকা উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে। একাডেমির সচিবের পদ শূন্য হলে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সচিব আসার আগে চুক্তিভিত্তিক একজন কর্মকর্তাকে সচিবের দায়িত্ব দিয়ে এ অর্থ উত্তোলন করেন বলে অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।

ডিজির এই আর্থিক অনিয়মসহ স্বেচ্ছাচারিতার ঘটনা সংসদীয় কমিটির সুপারিশে ইতোমধ্যে তদন্ত শুরু করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের সচিব মনসুর বলেন, ‘অডিট চলছে, অনিয়ম হলে বের হবে।’

দুদকও এসব অনিয়মের অভিযোগ যাচাই-বাছাই করছে। একইসঙ্গে যে প্রশ্ন সামনে এসেছে তা হলো, এই বিপুল পরিমাণ টাকা এখন কোথায়? আগাম টাকার সেটলমেন্টই বা কতদিনের মধ্যে করার নিয়ম?

চেকে বরাদ্দ করা টাকা কোথায়?

জানা গেছে, শিল্পকলার আগের সচিব মো. নওসাদ হোসেন গত ৩০ জুন বদলি হন। ওই দিনই শিল্পকলা একাডেমির ডিজি লিয়াকত আলী লাকী নতুন আদেশ জারি করে একাডেমির চুক্তিভিত্তিক পরিচালক (চারুকলা) সৈয়দা মাহবুবা করিমকে (মিনি) সচিবের দায়িত্ব দেন। ওই আদেশে বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে একাডেমির অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার প্রয়োজনে নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত সচিব যোগদানের আগপর্যন্ত নিজ দায়িত্বের পাশাপাশি সচিবের অতিরিক্ত দায়িত্ব তাকে প্রদান করার কথা বলা হয়।

নৃত্যকথা, আনিসুর রহমান, চন্দন দত্ত, ঘাস ফুল নদী, শামীমা আক্তার জাহান, সামিনা হোসেনসহ নানা সংগঠন ও কর্মকর্তাদের নামে ৩০ জুন চেক ইস্যু হয়। এই টাকাগুলো এখন কোথায়?

প্রশ্ন করা হলে শামীমা আক্তার জাহান বলেন, ‘আমার কাছে কোনও চেক আসেনি। বিভাগের কারও কাছে এসে থাকতে পারে।’

চন্দন দত্তের নামে বরাদ্দকৃত সাড়ে তিন লাখ টাকা মুজিববর্ষের কাজ বাবদ সিনিয়র ইনসট্রাক্টর আনিসুর রহমান, ফারহানা সোমা ও মুকুলকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

যদিও অফিস সূত্র বলছে চন্দন দত্ত যাদের টাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন, তাদের টাকা চন্দন দত্তের তোলার যৌক্তিক কারণ নেই। এবং মুজিববর্ষ উদযাপনের ফান্ডও আলাদা ছিল। রাজস্ব থেকে সেই খরচ যোগানোর কথা নয়।

এদিকে আনিসুর রহমানের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে কথা বলতে শুরু করলেও চেকের বিষয়ে জানতে চাইলে ‘আমি অফিসের বাইরে। টেলিফোনে এসব নিয়ে বলতে চাই না’ বলে কল কেটে দেন।

 লক্ষাধিক টাকার ওপেন চেক

সরকারি অফিসের নিয়ম অনুযায়ী কাউকে চেক দেওয়ার ক্ষেত্রে অ্যাকাউন্ট পে চেক দেওয়া হয়ে থাকে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতেই এই ব্যবস্থা। কিন্তু বিভিন্ন সংগঠন ও একাডেমির কর্মকর্তাদের নামে চলতি বছর ৩০ জুন স্বাক্ষরকৃত যতগুলো চেকের তথ্য এসেছে তার সবই ওপেন চেক।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ৩০ জুন তারিখ দেখিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা। পুরো টাকাটাই ভুয়া ভাউচার ও বিধিবহির্ভূত অগ্রিম গ্রহণের মাধ্যমে নগদ (ক্যাশ) উত্তোলন করা হয়। হাতেগোনা কয়েকটি বাদে কোনও চেকই একাউন্ট পে ছিল না।

কর্মকর্তারা জানান, ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হলেও ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত এ টাকা তোলা হয়। একই উপায়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরেও তুলে নেওয়া হয়েছিল ৩৪ কোটি টাকা।

উল্লেখ্য, ১৬ আগস্ট ২০২১ তারিখে চিত্রকর্ম ক্রয়ের নামে একটি চেকের (চেক নং ১০০২৬৬৭১৮৫, তারিখ ১৬/০৮/২০২১) মাধ্যমেই পিপিআর-২০০৮-এর বিধি লঙ্ঘন করে পরিষদ বা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়াই তুলে নেওয়া হয়েছে নগদ ৮ কোটি টাকা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. সায়েমা হক বিদিশা বলেন, ‘এ ধরনের চেক কোনোভাবেই ওপেন হওয়া উচিৎ নয়। এতগুলো আগাম চেক বাজেট বছরের শেষ দিন ৩০ জুনে দেওয়া। এতে স্পষ্ট যে, তারা টাকাটা এই বছরের খরচ হিসাবেই দেখাতে চান। এখানে বড় ধরনের ইঙ্গিত আছে।’

কীভাবে লিয়াকত আলী লাকি ও মিনি করিম জড়িত?

৩০ জুন ২০২১ তারিখের পর অর্থবছর সমাপন এবং উদ্বৃত্ত অর্থের হিসাব মন্ত্রণালয়কে প্রদান না করে সৈয়দা মাহবুবা করিমকে (মিনি করিম) সচিবের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমে একাডেমির ২টি ব্যাংক হিসাব (৪৪৩২১৩৩০০২৪৩৭ এবং ৪৪৩২১৩৩০০২৪৪৫) হতে অব্যয়িত অর্থ উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। যদিও মন্ত্রণালয় থেকে আদেশপ্রাপ্ত কোনও সচিব ছাড়া একাডেমির ডিজির আদেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির চেকে স্বাক্ষর করার সুযোগ নেই। শিল্পকলা একাডেমির নিয়ম অনুযায়ী মহাপরিচালকও সেটা পারেন না। বিধি অনুযায়ী সচিব বা একাডেমির অর্থ বিভাগের কর্মকর্তাই শুধু চেকে স্বাক্ষর করতে পারেন।

মিনি করিমকে অনিয়মের মাধ্যমে সচিবের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া এবং তার চেকে স্বাক্ষর করাকে ‘বৈধতা’ দেওয়ার দায় মহাপরিচালকের বলে মনে করেন পরিষদের সদস্য রামেন্দু মজুমদার।

শিল্পকলা একাডেমিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৩০ জুন থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত প্রথম দফায় সচিবের দায়িত্ব পালন করেন মিনি করিম। অভিযোগ আছে, ওই সময় পেছনের তারিখে প্রায় ২৬ কোটি টাকার চেকে স্বাক্ষর করেন তিনি। আগের তারিখে স্বাক্ষর করে ১৬ আগস্ট ৮ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

মন্ত্রণালয় থেকে এ বছরের ১৯ জুলাই তারিখে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগকৃত পরিচালক সৈয়দা মাহবুবা করিমকে সচিবের অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করার বিষয়ে মহাপরিচালকের অফিস আদেশের আইনগত বৈধতা চেয়ে ব্যাখ্যা তলব করা হয়, যার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি মহাপরিচালক।

২৬ কোটি টাকা কোথায় গেলো জানতে চাইলে মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ‘২৬ নয় ১৯ বা ২০ কোটি হবে, ২ কোটি ভ্যাট। বাকিটার মধ্যে নওশাদ সাহেবের অনুমোদিত অর্থ আছে।’

তা হলে ব্যাংক স্টেটমেন্ট ভুল বলছে কিনা জানতে চাইলে তিনি অডিট যারা করছে তাদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সেখানে উপস্থিত উপসচিব (প্রশাসন) জাকির হোসেনকে কিছু বলতে বলেন। জাকির হোসেন বলেন, ‘ব্যাংকের কাগজ আমাদের অ্যাকাউন্টসে আছে। এখনও এই তিন মাসের বরাদ্দ আসেনি।’

তা হলে বেতনভাতা কীভাবে হয় প্রশ্নে মহাপরিচালক বলেন, ‘পেনশন খাত থেকে বেতন দেওয়া হচ্ছে।’

শিল্পকলা একাডেমি নিয়ে নানা অভিযোগ কেন শোনা যায় জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘সে প্রশ্ন আমারও। বুঝতে পারছি না। এই সংগঠন অনেক বেশি সক্রিয়, উন্নতিও করেছে, প্রফ্শনাল জেলাসি থাকতে পারে।’

৩০ জুন ১৬শ চেক স্বাক্ষর হলো, এটা সমন্বয় হলো কখন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটাতো সুখবর। এত নাট্যদল, যাত্রাদল, নৃত্যদল কাজ করছে।’

এসময় প্রতিবেদক আবারও একই প্রশ্ন করেন- শিল্পকলার কর্মকর্তা আনিসুর রহমান, চন্দন দত্ত, শামীমা আক্তার জাহানসহ এতজনের অগ্রিম চেক, তারা কখন সমন্বয় করলেন? উত্তরে মহাপরিচালক বলেন, ‘২০ বছর আগের অডিট আপত্তি এখানে এখনও আছে। অনেকে ঠিক সময় সমন্বয় করেন না।’

শেষে মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী তিনি স্বীকার করেন, ‘এরা কেউ সমন্বয় করেননি। আগামী সমন্বয় সভায় তাদের সেটা বলে হবে।’

 সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন