শিরোনাম
ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কর্ণাটকে কলেজে হিজাব নিষিদ্ধ করা নিয়ে দেশজুড়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। মুসলিমদের ধর্মীয় প্রতীক ও আচারের ওপর ‘আঘাত’ দেশটির সংখ্যালঘুদের ওপর সংখ্যাগুরু হিন্দুদের চাপানো মূল্যবোধের কট্টর অ্যাজেন্ডার অংশ মনে করা হচ্ছে।
ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের সংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। দেশটির সংবিধান তাদের যে ধর্মীয় স্বাধীনতা দিয়েছে, হিজাব নিষিদ্ধের মাধ্যমে তা লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। গত শুক্রবার ইউএস অ্যাম্বাসেডর-অ্যাট-লার্জ ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম বলেন, হিজাব নিষিদ্ধ নারী ও মেয়েদের অপমানিত ও প্রান্তিক করবে।
কেন্দ্রের মতো কর্ণাটক রাজ্যেও ক্ষমতায় দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। দলটি হিজাব নিষিদ্ধের বৈষম্যমূলক নিষেধাজ্ঞাকে সমর্থন দিচ্ছে। বিজেপি কয়েক দশক ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউসিসি) চালুর আরজি জানিয়ে আসছে, যেটাকে সংখ্যালঘুরা হিন্দু আইন চালিয়ে দেওয়ার শামিল হিসেবে দেখছেন।
গত মঙ্গলবার রাজ্যে হিজাব পরা মুসলিম ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে প্রবেশে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। অনেক শিক্ষার্থীকে স্কুলের বাইরে হিজাব খুলতে দেখার দৃশ্য সমালোচনার জন্ম দিয়েছে, যেটাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা ‘অপমানজনক’ বলে মন্তব্য করেন।
অ্যান্টস অ্যামাং এলিফ্যান্টস বইয়ের লেখক সুজাতা গিদলা বলেন, এই ঘটনা ২০১৬ সালে ফ্রান্সে বুর্কিনি পরা মুসলিম নারীদের পুলিশের হেনস্তা করার কথা মনে করিয়ে দেয়।
কর্ণাটকের শিবামংগা জেলার কর্ণাটক পাবলিক স্কুলের শিক্ষার্থী আলিয়া মেহের আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমাদের প্রায় ১৩ জনকে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। কারণ, আমরা স্কুলের পোশাকের সঙ্গে মাথায় স্কার্ফ পরেছিলাম। তারা আমাদের বলে আমরা হিজাব পরলে প্রি-বোর্ড পরীক্ষায় বসতে পারব না। আমরা জানাই, এমন হলে আমরা পরীক্ষা দেব না। কিন্তু হিজাব ছাড়তে পারব না। হঠাৎ করেই তারা আমাদের মাথা থেকে হিজাব সরাতে বলে।’
ওই স্কুলেরও আরেক শিক্ষার্থীর মা রেশমা বানু বলেন, তাঁকেও স্কুলে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। হিজাব নিষিদ্ধ ‘অগ্রহণযোগ্য’। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘হিজাব হলো আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা আমাদের সন্তানদের এখানে ভর্তি করেছি কারণ, আমরা মনে করেছি— তাদের এখানে সম্মান করা হবে।’
কিন্তু স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুশীলা ভি বলেন, তাঁর স্কুল সরকারি নির্দেশ মানতে বাধ্য। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘এটি প্রি-বোর্ড পরীক্ষা। পরেও আমরা তাদের এই পরীক্ষা নিতে পারব। আমরা আদালতের রায় অনুযায়ী প্রয়োজনীয় বিধিমালা কার্যকর করব।’
এরই মধ্যে কর্ণাটক হাইকোর্টে হিজাব নিষিদ্ধের বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করেছে মুসলিম শিক্ষার্থীরা।
গত ডিসেম্বরে এই বিতর্কের সূত্রপাত। কর্ণাটকের উদুপি জেলায় একটি সরকারি কলেজে বাইরে একদল হিজাব পরা মুসলিম ছাত্রী বিক্ষোভ করেন। তাঁদের অভিযোগ, হিজাব পরার কারণে তাঁদের কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তখন থেকে এ নিয়ে বিতর্ক শুরু। ওই ঘটনার ভিডিও ইন্টারেনেট ছড়িয়ে পড়লে তা নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। অধিকারকর্মীরা হিজাব নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানান। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ ও সরকার তাদের সেই দাবি কর্ণপাত না করে ওই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করে। হিজাব নিষিদ্ধের দাবিতে গেরুয়া পোশাক পরে হিন্দু শিক্ষার্থী ও কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও একই পথে হাঁটে।
বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। হিজাব নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে করা দুটি রিটের শুনানি কর্ণাটক হাইকোর্টে চলছে। এরই মধ্যে হাইকোর্টের বেঞ্চ বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কেউ যেন ধর্মীয় পোশাক পরে স্কুল-কলেজে না আসেন সেই নির্দেশ দেন। তবে আইনজীবীরা আদেশটির সমালোচনা করে বলেন, এটি ‘মৌলিক অধিকার স্থগিত’ করারই নামান্তর।
গত মঙ্গলবার রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে হিন্দু শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এর মধ্যে একটি কলেজে এক শিক্ষার্থীকে হিজাব পরার কারণে একদল হিন্দু শিক্ষার্থী তাঁকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। এ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়ায়। কলেজে ড্রেস কোডের বিষয়টি এখন হিন্দু-মুসলিম ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক জায়গায় হিজাবের বিরোধিতা করতে হিন্দু শিক্ষার্থীরা মাথায় গেরুয়া রঙের পাগড়ি পরে কলেজে আসতে শুরু করেছে। উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ রাজ্যে প্রভাবশালী হিন্দু সংগঠনগুলো হিজাবের বিরোধিতা করছে।
ডিসেম্বরে ঘটনার সূত্রপাতের পর ডানপন্থী কট্টর মুসলিম শিক্ষার্থীদের গ্রুপ ক্যাম্পাস ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া ( সিএফআই) প্রথম বিষয়টির প্রতিবাদ জানায়। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে গ্রুপটি বেশ সক্রিয়। তারাই দাবি করে, কলেজ কর্তৃপক্ষ মুসলিম শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় ও শিক্ষার অধিকার লঙ্ঘন করছে।
সিএফআইয়ের একজন সদস্য সাইদ সরফরাজ আল-জাজিরাকে বলেন, হিজাবের বিরোধিতা করার জন্য হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলগুলোর কর্মকাণ্ডের পেছনে সরকারের সমর্থন ও উসকানি ছিল। তিনি বলেন, বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, বিভিন্ন জেলায় হিজাববিরোধী বিক্ষোভে হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোর নেতাদের পরনে গেরুয়া রঙের উত্তরীয় ছিল।
দ্য নিউজ মিনিট ওয়েবসাইটের পরিচালিত এক তদন্তে পাওয়া তথ্যমতে, হিজাববিরোধী বিক্ষোভগুলো মোটেও স্বতঃস্ফূর্ত ছিল না। তবে এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হিন্দুত্ববাদী চক্রান্ত ছাড়া কিছুই না। কর্ণাটকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের যে চেষ্টা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে এটা তারই নমুনা।
উপকূলীয় কর্ণাটকেই বিক্ষোভ কেন?
চলমান বিতর্কের কেন্দ্র উদুপি। কর্ণাটকের এই জেলাটিকে ক্ষমতাধর বিজেপির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বেঙ্গালুরুর একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক সমর হলর্নকার বলেন, উপকূলীয় কর্ণাটক হলো ‘হিন্দুত্ববাদের মূল’ রাজনীতি এবং ‘এর প্রমাণের ক্ষেত্র’।
আর্টিকেল-১৪ নিউজ ওয়েবসাইটের সম্পাদক হলর্নকার আল-জাজিরাকে বলেন, ‘হিন্দু এবং মুসলিম উভয় মৌলবাদেরা কর্ণাটকের উপকূলীয় জেলাগুলোতে উর্বর ভূমি খুঁজে পেয়েছে। রাজ্যটিতে মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মুসলিম।’
কয়েক বছর ধরে কর্ণাটকে হিন্দুত্ববাদী গ্রুপগুলোর কর্মকাণ্ড বাড়ছে এবং তারা রাজ্যের সংখ্যালঘুদের টার্গেট করেছে বিশেষ করে মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের।
গত মাসে কর্ণাটকে বিধানসভা একটি আইন পাস করে ধর্মান্তরিতকরণ নিষিদ্ধ করা হয়। বিজেপি সরকারের অভিযোগ, রাজ্যটিতে খ্রিষ্টান মিশনারিজ গ্রুপগুলো জোর করে হিন্দুদের খ্রিষ্টান বানাচ্ছে। তবে খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতারা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এই রাজ্যে বিজেপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস এই হিজাব নিষিদ্ধকরণকে ‘অমানবিক ও সাম্প্রদায়িক’ বলে মন্তব্য করেছে। আগামী বছরের নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করতে বিজেপি সরকার এই বিতর্ক তৈরি করেছে বলে কংগ্রেসের অভিযোগ।
কর্ণাটক বিধানসভার এক কংগ্রেস সদস্য কানিজ ফাতিমা কট্টরপন্থী হিন্দু গ্রুপগুলোর উদাহরণ টেনে আল-জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা বহু বছর ধরে হিজাব পরে আসছি। কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন আচমকা বিজেপি এই ইস্যুটি তৈরি করেছে আর হিন্দুত্ববাদী গ্রুপগুলো সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করছে।’
হলর্নকার মনে করেন, হিজাব ইস্যুকে হিন্দু মৌলবাদী দলগুলো একটি সুযোগ হিসেবে নিয়েছে এবং সমাজকে আরও উগ্রবাদী করে তুলতে এটি ব্যবহার করেছে।’
তবে বিজেপির মুখপাত্র স্মৃতি হারতিজ আল-জাজিরাকে বলেন, একই ধরনের পোশাক পরার উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব বা গেরুয়া রঙের পাগড়ির কোনো স্থান নেই। মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরার দাবিকে তিনি ‘অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক’ বলে অভিহিত করেছেন।
উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা
হিজাব বিতর্ক নিয়ে উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে যে ব্যাখ্যা হাজির করা হচ্ছে তার সমালোচনা করেছেন হিজাবের পক্ষের অধিকারকর্মী ও গ্রুপগুলো। তাদের দাবি, সংবাদমাধ্যমে বিষয়টি যেভাবে তুলে ধরা হচ্ছে তা ‘মিথ্যা চিত্রই ফুটে’ উঠছে।
এই বিষয়ে অধিকারকর্মী লাদিদা ফারজানা আল-জাজিরাকে বলেন, কট্টর ডানপন্থী বাহিনীকে সমর্থনকারী গণমাধ্যম ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছে যে ‘হিজাব পরা যদি আমাদের অধিকার হয়, তাহলে গেরুয়া উত্তরীয় পরা তাদের অধিকার’। তারা গেরুয়া উত্তরীয়র সঙ্গে হিজাবকে মিলিয়ে বিষয়টি হাইজ্যাক করছে।’
মুসলিমদের আশঙ্কা, ইউনিফর্ম সিভিল কোডের নামে আইন জারি করতে হিন্দুত্ববাদী গ্রুপগুলোর বড় অ্যাজেন্ডার অংশ এই ধরনের বিতর্ক। এরই মধ্যে দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘কমন ড্রেস কোড’ বাস্তবায়ন করতে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতেও আবেদন করা হয়েছে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউনিফর্ম সিভিল কোডের সঙ্গে হিজাব পরিধানের কোনো সম্পর্ক নেই।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য শামসাদ বলেন, হিজাব হলো মৌলিক স্বাধীনতার বিষয়। আর ‘অভিন্নতা’ একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। কারণ, একটি স্কুলে কখনো সব শিক্ষার্থী ‘অভিন্ন’ হয় না।
কুন্দাপুরার আরএন শেটি পিইউ কলেজ ১৬ বছরের শিক্ষার্থী আয়শা নওরিন বলে, ‘জানি না আদালত কী আদেশ দেবেন। ক্যাম্পাসে ফেরা নিয়ে এক ধরনের অনিরাপত্তা কাজ করছে। কারণ, ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাইরে আমাদের বিরুদ্ধে কেউ কেউ অবস্থান নিয়ে আছে। এমনকি আমরা সতীর্থদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারি।’