শিরোনাম
অনবদ্য ভদ্রতার জন্য পরিচিত দেশ কানাডার খ্যাতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় টিকাদানসংক্রান্ত সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কানাডায় বেশ কিছু দিন ধরে ট্রাকচালকদের নেতৃত্বে ‘ফ্রিডম কনভয়’ নামে বিক্ষোভ চলছে।
বিক্ষোভকারীরা দেশটির রাজধানী অটোয়াসহ আরও কিছু এলাকায় যাওয়ার প্রধান সড়ক বন্ধ করে দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন। তাঁরা অটোয়ার পার্লামেন্টের বাইরেও অবস্থান নিয়েছেন। তাঁদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডের ভাষাও ভদ্রোচিত নয়, তাতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে গালাগাল দিতেও দেখা গেছে। বিক্ষোভকারীদের অনেকেই কানাডার কোভিড বিধিনিষেধকে নাৎসিবাদের সঙ্গে তুলনা করছেন। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বেশ কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর সরকার ঘৃণা–বিদ্বেষ ছড়ানো রোধ করতে তৈরি করা আইনে দুটি উদ্বেগজনক পরিবর্তনের কথা ভাবছে। বিশ্লেষকেরা আশঙ্কা করছেন, এতে মানুষের বাক্স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হবে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, কানাডা-যুক্তরাষ্ট্র সীমান্তে ট্রাক চালানোর ক্ষেত্রে করোনার টিকা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করায় জানুয়ারি মাস থেকে এর বিরোধিতা করে ‘ফ্রিডম কনভয়’ বিক্ষোভ শুরু হয়। কানাডার ট্রাকচালক ও তাঁদের সমর্থকেরা গাড়িবহর নিয়ে অটোয়ার রাস্তা দখল করে বিক্ষোভ শুরু করেন। বিভিন্ন সীমান্ত এলাকাও অবরুদ্ধ করেন তাঁরা। কয়েক দিন ধরে অবরুদ্ধ থাকার পর কানাডা কর্তৃপক্ষ বিক্ষোভকারীদের সেখান থেকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তবে অটোয়াতে কিছুসংখ্যক ট্রাকচালক ট্রুডোর জারি করা জরুরি আদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে এখনো তাঁদের অবস্থানে অটল।
যদিও বেশির ভাগ কানাডার নাগরিক মনে করেন, সরকার করোনার যে বিধিনিষেধ জারি করেছে, তা যুক্তিসংগত। কিন্তু প্রতিবাদকারীরা কিছু বিষয়ের সঙ্গে একে গুলিয়ে ফেলছেন। বেশ কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মহামারির সময় সরকারের কঠোর বিধিনিষেধের কারণে বিরক্ত। লকডাউনে চাকরি হারানো যুবকেরাও রয়েছেন বিপদে। পরিবারের দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে অথচ কাজ করতে না পেরে তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। ট্রাকচালকেরা দেশের বাইরে থেকে সমর্থন ও আর্থিক সহযোগিতাও পেয়েছেন।
ইকোনমিস্ট বলছে, এই পরিস্থিতিতে কানাডা সরকারের উচিত ছিল ক্ষতিকারক কর্মসূচি, ঘৃণ্য বক্তব্য ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট করা। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করলে তা ঠিক আছে, তবে গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক অবরোধ করে অন্যের ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা ঠিক হয়নি। আন্দোলনরত ট্রাকচালকেরা কানাডা থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ব্যস্ততম সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সীমান্ত ক্রসিংটি অ্যাম্বাসেডর ব্রিজ নামে পরিচিত। সেটি কানাডার অন্টারিও প্রদেশের উইন্ডসোর ও যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েট শহরে মধ্যকার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সরাতে ছয় দিন সময় নেয়। এ বিক্ষোভের কারণে ৩৫ কোটি মার্কিন ডলার বাণিজ্য অবরুদ্ধ হয়ে যায়।
ইকোনমিস্টের দৃষ্টিতে সীমান্তে টিকার বাধ্যবাধকতা নিয়ে ট্রাকচালকেরা যা করেছেন, তা তাঁদের ভুল ছিল। সরকার সংক্রামক করোনার বিস্তার ঠেকাতে যা করেছে, তা যুক্তিসংগত। কিন্তু ট্রাকচালকদেরও তাঁদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। সরকারকে অবশ্যই তাঁদের কথা শুনতে হতো এবং নম্রভাবে তার প্রতিক্রিয়া জানাতে হতো। ট্রাকচালকদের অভিযোগগুলো গুরুত্বের সঙ্গে শোনার পাশাপাশি ধৈর্য ধরে তাঁদের করোনার বিধিনিষেধের বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে হতো। এটি যদিও কঠিন, তবে তা সময়ের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। কিন্তু জাস্টিন ট্রুডো এর বিপরীত পথে হেঁটেছেন। তিনি বিক্ষোভাকারীদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেছেন। তাঁদের গোঁড়া অ্যাখ্যা দিয়ে সীমানাছাড়া করার চেষ্টা করেছেন।
পুলিশের হাতে ইতিমধ্যেই বিশৃঙ্খলা দমন করার যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। এর মধ্যেও ১৪ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভ ঠেকাতে কেন্দ্রীয় জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার করেন ট্রুডো। দেশজুড়ে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে সমর্থন দিতে এবং এবং তাদের শক্তি বাড়াতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানান তিনি। জরুরি আইনের আওতায় ৩০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করে ‘সাময়িকভাবে বিশেষ পদক্ষেপ’ নেওয়ার সুযোগ পায় কেন্দ্রীয় সরকার। শান্তিপূর্ণ সময়ে কানাডার ইতিহাসে জরুরি ক্ষমতা প্রয়োগের ঘটনা বিরল। এর আগে ১৯৭০ সালের অক্টোবরে ট্রুডোর পিতা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো জরুরি আইনের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন। এবার দ্বিতীয়বারের মতো এ আইনের প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে। এর ফলে বিক্ষোভকে বেআইনি ঘোষণা করতে এবং আদালতের আদেশ ছাড়াই বিক্ষোভকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার অনুমতি পায় সরকার।
এদিকে ট্রুডোর লিবারেল সরকার কানাডার ঘৃণা-বক্তৃতা আইনে দুটি উদ্বেগজনক পরিবর্তনের কথা ভাবছে। যদিও আইনটি ইতিমধ্যে কট্টর বলে সমালোচিত। দুটি পরিবর্তনের একটি হচ্ছে কেউ বিদ্বেষপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করলে বড় জরিমানা আরোপের অনুমতি পাবে কানাডার মানবাধিকার ট্রাইব্যুনাল। প্রস্তাবিত অন্য পরিবর্তনটি হচ্ছে কেউ যদি আগে থেকে কারও কাছ থেকে ঘৃণ্য বক্তব্যের আশঙ্কা করে, তবে তার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। ইকোনমিস্ট বলছে, দুটিই ভয়ানক ধারণা। ইকোনমিস্টের ভাষ্য, শুধু ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে বাক্স্বাধীনতা সীমিত করা উচিত। যেমন যখন বক্তা শারীরিক সহিংসতাকে উসকে দিতে পারে তখনকার বিষয়টি বিবেচনায় এ ধরনের পদক্ষেপ সহনীয়।
কানাডার আইনে ইতিমধ্যে কণ্ঠরোধের মতো বিষয় রয়েছে। দেশের উদারপন্থী বামরা চাইবেন এটি আরও কট্টর হোক। প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলো উদারপন্থী কর্মী, রক্ষণশীল ধার্মিক ব্যক্তি, নারীবাদীদের হয়রানির জন্য আইনি হাতিয়ার দেবে। আরও বাজে পরিস্থিতি হলে কিছু বলার আগে তাঁদের আটকে রাখার অনুমতি দেবে।
কানাডা এখনো বিদ্বেষপূর্ণ বা বিভক্ত সমাজ নয়। ট্রুডো যদি এভাবেই তাঁর দেশকে রাখতে চান, তবে তাঁর উচিত কানাডিয়ানদের চিন্তাভাবনা আটকে দেওয়ার চেষ্টা বন্ধ করা। ইকোনমিস্ট, এএফপি অবলম্বনে।
সূত্র: প্রথম আলো