রণসজ্জায় সঙ্গী কারা ইউক্রেনের?

ফানাম নিউজ
  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪:০৬

রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ করছে-এমন আশঙ্কা থেকেই ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে সামরিক ও প্রতিরক্ষামূলক সহায়তা চেয়েছে কিয়েভ। কেউ সাড়া দিচ্ছে, কেউ মুখের ওপরই বলে দিচ্ছে ‘না’। 

লুক্সেমবার্গের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন অ্যাসেলবর্ন বলেছেন, ‘রাশিয়ার সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের মধ্য ইউক্রেনের পক্ষে শুধু অস্ত্র পাঠানোই ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে এমন ধারণা ভুল।’ ইউক্রেনে অবশ্য সামরিক সাহায্য প্রদানে এই অনীহা নিয়ে হতাশাও রয়েছে। জার্মান প্রকাশ্যে ইউক্রেনের বিরোধিতা করেছে। আবার এক কথাতেই অস্ত্র দিতে রাজি হয়ে গেছে ন্যাটোভুক্ত ৩ বাল্টিক রাষ্ট্র-ইস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং ন্যাটোর অপর দুই সদস্য চেক প্রজাতন্ত্র ও পোল্যান্ড।

গত সপ্তাহে পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনে অস্ত্রসহ বেশকিছু সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছেন। তার ঘোষণায় রয়েছে, হাজার হাজার বুলেট, আর্টিলারি গোলাবারুদ, ম্যানপ্যাডস, হালকা মর্টার, রিকনেসান্স ইউএভি এবং অন্যান্য ধরনের প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো শর্ত আছে কি-না, তা পরিষ্কার করেননি মাতেউস। দেশটির শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইয়াগো রড্রিগেজ বলেছেন, ‘এটা বিশ্বাস করা উচিত যে, ওয়ারস ইতোমধ্যে কামিকেইজ ড্রোন পাঠিয়েছে, যা গোলাবারুদে পরিপূর্ণ এবং একটি এলাকার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে লক্ষ্যবস্তুর ওপর শুধু একবার আঘাত করে।

রাশিয়ার আগ্রাসনের হুমকির মুখে দেশটির সমর্থনের অংশ হিসাবে চেক সরকার জানুয়ারিতে বেশ কয়েকটি আর্টিলারি রাউন্ড (মর্টার শেল) সরবরাহ করেছে। চেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের ভিত্তিতে ইউক্রেনে বিনা খরচে ১.৭ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৪ হাজার ‘ ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ১৫২ মিলিমিটার শেল’ স্থানান্তর অনুমোদন দেওয়া হয়। যুদ্ধ সরঞ্জাম দেবে তিন বাল্টিক রাষ্ট্র লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া। লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া স্টিংগার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ক্ষেপণাস্ত্র এবং সম্পর্কিত সরঞ্জাম সরবরাহের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। একটি অনির্দিষ্ট পরিমাণ জ্যাভলিন অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল দেবে এস্তোনিয়া। তবে জার্মান সরকার ইউক্রেনে এই অস্ত্র সরবরাহের জন্য এস্তোনিয়ার অনুরোধের অনুমতি বিবেচনা করছে। এই উত্তেজনার মধ্যেই ইউক্রেনে ৫০০০ হেলমেট পাঠিয়েছে বার্লিন। রড্রিগেজ বলেছেন, ‘এটি জার্মানির অনুল্লেখযোগ্য সহায়তা। বরং বলা যেতে পারে এর পেছনেও রাজনীতি রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘জার্মানি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে অর্থনৈতিক সাহায্যই যথেষ্ট ছিল। তাদের অস্ত্র না পাঠাতে চাওয়ার মানে শান্তি বেছে নেওয়া নয়। এর মানে হচ্ছে কোনো মূল্যে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াতে রাজি না হওয়া।’ বার্লিন আগামী কয়েক বছরে কিয়েভকে ২ বিলিয়নের বেশি ইউরোর অর্থনৈতিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। যদিও তারা সোমবার ঘোষণা করেছে-পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো যুদ্ধ গোষ্ঠীগুলোতে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠাবে।

স্পেন, হল্যান্ড এবং ডেনমার্ক : স্পেন কৃষ্ণ সাগরে ফ্রিগেট এবং ফাইটার জেট সরবরাহ শুরু করেছে। হল্যান্ড এবং ডেনমার্ক রাশিয়াকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে বিরত রাখার জন্য ন্যাটোর অন্যান্য দেশে সৈন্য সরিয়ে নিয়েছে। রড্রিগেজ বলেন, ‘এটা ভাবা যায় না যে ইইউ ইউক্রেনকে তার সীমান্ত রক্ষায় সামরিকভাবে সাহায্য করতে পারে। ইইউ চুক্তিতে, ব্লকটি শুধু অন্য সদস্য রাষ্ট্রকে রক্ষা করার জন্য হস্তক্ষেপ করতে পারে।’ কিয়েভের ইন্টারন্যাশনাল রেনেসাঁ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ওলেক্সান্ডার সুশকো ইউরোনিউজকে বলেছেন, পূর্ণমাত্রায় ইউক্রেন দখলের আশঙ্কা নেই। তিনি বলেন, ‘আমি ইউক্রেনের সম্পূর্ণ দখলে বিশ্বাস করি না। জনসংখ্যা এর বিরুদ্ধে এবং এজন্য মস্কোর যথেষ্ট সম্পদ নেই।

সাবেক ‘অস্ত্রস্বর্গ’ ইউক্রেন : ইউক্রেনের কি সত্যিই আত্মরক্ষার জন্য আরও অস্ত্র দরকার? দেশটি কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম বড় অস্ত্র রপ্তানিকারক ছিল। যখন এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, সে সময়ে সোভিয়েত অস্ত্রের ৩০ শতাংশই সরবরাহ করত ইউক্রেন। সংখ্যার দিক থেকে দেশটির ৭৫০ টিরও বেশি কারখানায় ১০ লাখ শ্রমিক এ কাজে নিযুক্ত রয়েছেন। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তাদের অনেক অস্ত্রই কালোবাজারে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে যায়। ২০১২ সালে কিয়েভ ছিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। পাকিস্তান, চীন এবং রাশিয়া ছিল এর সেরা গ্রাহক। তবে তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল-অস্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরিতে সেরা হলেও সম্পূর্ণ অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম শিল্প তাদের ছিল না। তাছাড়া আরেকটি বড় সমস্য ছিল দুর্নীতি। ২০১০ সালের পর থেকে দুর্নীতির কারণে তাদের দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজার সামরিক কর্মী ছিলেন, যাদের মধ্যে মাত্র ৬,০০০ জনের সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল। বিশাল বাকিরা ছিল প্রশাসনের অকেজো অংশ।

যে শর্তে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে আমেরিকা : ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর জন্য ওয়াশিংটন যে শর্তগুলো বেঁধে দিয়েছিল, তার মধ্যে অন্যতম হলো সব স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়মিত সেনাবাহিনীতে থাকতে হবে। আধাসামরিক গোষ্ঠীগুলোকে তখন নিয়মিত সৈন্যবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর এই হিসাবেই ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের খাতাকলমে ইউক্রেনের সেনা সংখ্যা বেড়ে হয়েছে আড়াই লাখ। মার্কিনিরা ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনকে আড়াই বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে যানবাহন এবং আর্টিলারি-বিরোধী রাডার। ইউক্রেনের সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্য সামরিক প্রশিক্ষক পাঠিয়েছে ন্যাটোও।