শিরোনাম
আফগানিস্তানে গত আগস্টে তালেবানের ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত বুধবার থেকে খুলেছে কিছুসংখ্যক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এদিন পুরুষ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ক্লাসে ফিরেছেন নারী শিক্ষার্থীরাও। প্রায় ছয় মাস আগে ক্ষমতা দখল করে নারীদের উচ্চশিক্ষা ও চাকরি থেকে দূরে থাকতে বলেছিল তালেবান। তবে শেষ পর্যন্ত আবারও ক্লাসে ফিরতে পারায় নারী শিক্ষার্থীদের অনুভূতি কী, তাঁরা ভবিষ্যৎ নিয়ে কী আশা করছেন, তা নিয়ে বিশেষ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। নিরাপত্তার কারণে এই নারীদের কয়েকজনের নামে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
কান্দাহার বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থী রানা বিবিসিকে বলেন, ক্লাসে ফিরতে প্রস্তুতি নেওয়ার সময়ও দুশ্চিন্তায় ছিলেন তিনি। রানা বলেন, ‘আমি খুব উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলাম। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবেশ করি, তখন তালেবান সদস্যরা সেখানে পাহারা দিচ্ছিলেন। তবে তাঁরা আমাদের বিরক্ত করেননি।’
রানা আরও বলেন, ‘অনেক কিছুই আগের মতো স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছোট হওয়ার কারণে নারী ও পুরুষদের একই শ্রেণিকক্ষে পাঠদান হয়েছে। পুরুষ শিক্ষার্থীরা সামনের দিকে বসেছিল আর আমরা পেছনের দিকে বসেছি।’
হেরাত শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থী বিবিসিকে বলেন, তাঁকে বলা হয়েছে দিনে মাত্র চার ঘণ্টা ক্যাম্পাসে থাকতে পারবেন। আর বাকি সময় পুরুষ শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষমতা দখলের পর দৈনন্দিন জীবনযাপনের ওপর তালেবান যে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তার বেশির ভাগই নারীদের বিরুদ্ধে। আফগানিস্তানই বিশ্বের একমাত্র দেশ, যারা সরকারিভাবে নারী-পুরুষভেদে শিক্ষার সুযোগপ্রাপ্তিতে বৈষম্য তৈরি করেছে।
আফগানিস্তানে নারীদের জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক কর্মক্ষেত্রে নারীদের কাজ করার অনুমতি বাতিল করা হয়েছে। নারীদের হিজাব পরারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে ১৯৯০–এর দশকের মতো করে এবার আর নারীদের জন্য বোরকা বাধ্যতামূলক করেনি তালেবান সরকার।
তালেবানের নতুন সরকার বলছে, নারী শিক্ষা নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে তারা চায় আলাদা শ্রেণিকক্ষে নারী ও পুরুষদের পাঠদান, ইসলামের নীতির ভিত্তিতে পাঠ্যক্রম সাজানো এবং নারী শিক্ষার্থীদের জন্য হিজাব বাধ্যতামূলক করা হোক।
আশার মধ্যেও উঁকি দিচ্ছে সংশয়
বুধবার আফগানিস্তানে শীত কম অনুভব হওয়া ছয় প্রদেশের (লাগমান, নানগারহার, কান্দাহার, নিমরোজ, ফারাহ ও হেলমান্দ) সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শুধু খুলেছে। রাজধানী কাবুলসহ শীত বেশি অনুভূত হওয়া এলাকাগুলোতে ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার সম্ভাবনা নেই।
হোদা নামের এক শিক্ষার্থী কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পুর প্রকৌশল বিষয় নিয়ে আবারও পড়াশোনা শুরুর আশা করছেন। তিনি বলেন, ‘অনেক মাস ধরে বাড়িতে বসে থাকার পর ভালো খবর পেলাম। তবে আমি জানি, অনেক শিক্ষকই আফগানিস্তান ছেড়ে গেছেন।’
বিবিসি পশতুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত আগস্টে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে কাবুল, হেরাত ও বালখ—এ তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২৯ শিক্ষক আফগানিস্তান ছেড়েছেন।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান শাসনের প্রথম মেয়াদেও নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ ছিল। আর সে কারণে তালেবান সরকার সম্প্রতি নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার পরও সতর্কভাবে স্বাগত জানাচ্ছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
আফগানিস্তানে নিয়োজিত জাতিসংঘের সহায়তা মিশনের পক্ষ থেকে একটি টুইট করা হয়েছে। টুইটে বলা হয়, প্রত্যেক তরুণের জন্যই শিক্ষার সমসুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।
কিছুসংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় নারীদের জন্য খুলে দেওয়া হলেও আফগানিস্তানে নারীদের উচ্চশিক্ষা এখনো অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে।
তাখার প্রদেশের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহভাস বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া এবং চিকিৎসক হওয়াটা আমার স্বপ্ন। এখন আমি শুনছি, নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে দিচ্ছে তালেবান। আমি খুব আশাবাদী, তারা উচ্চবিদ্যালয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেবে।’
পড়াশোনা শেষ হলেও চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তা
অনেকের আশঙ্কা, তালেবান নারী শিক্ষার সুযোগকে সীমিত রাখতে পারে। নারীরা সব বিষয়ে পড়ার সুযোগ না–ও পেতে পারেন।
কাবুলের পুর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বলেন, সম্প্রতি তালেবানের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, নারীদের রাজনীতিবিদ কিংবা প্রকৌশলী হওয়ার দরকার নেই। এগুলো পুরুষদের কাজ।
একইভাবে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা অনুষদে পড়তে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা বিবিসিকে বলেন, কলা অনুষদের বিষয়গুলোতে পড়ার জন্য নারীদের অনুমতি দেওয়া হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় আছেন তাঁরা।
যাদের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ নেই, সেসব নারীরা যেন দূর থেকে অনলাইনে বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ নিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে অনলাইন হেরাত স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাঞ্জেলা ঘায়োর। তিনি বলেন, ‘আমার ধারণা, তালেবান তাদের পাঠ্যক্রমের মধ্যে শরিয়া ও ইসলামের বিষয়গুলো যুক্ত করবে। নারীরা আর খেলাধুলায় অংশ নিতে পারবে না। তাদের অনেক বেশি পর্দা করতে হবে। আমার ধারণা, তালেবানের অধীন চলা শিক্ষাব্যবস্থায় নারীরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারবে না। আর আমার মূল শঙ্কার জায়গাটা এখানেই। আমি সত্যিই ভীত।’
কিশোর বয়স থেকে শিক্ষকতা শুরু করা এই নারী আরও বলেন, বর্তমানে যে পরিস্থিতি চলছে, তাতে নারীরা স্নাতক সম্পন্ন করলেও কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পারবেন না।
হেরাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছেন সোরায়া। শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও বর্তমান বিধিনিষেধের কারণে চাকরি পাওয়ার সুযোগ নেই তাঁর।
বিবিসিকে সোরায়া বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে আমি বাড়ি থেকে বের হতে পারছি না। তারা (তালেবান) বলছে, নারীদের চাকরি করা উচিত নয়। অথবা যে প্রতিষ্ঠানের সব কর্মী নারী, সেখানেই তাঁরা কাজ করতে পারবেন। কিন্তু আফগানিস্তানে পুরুষ নেই এমন কর্মস্থলের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা।’
আন্তর্জাতিক চাপ
জানুয়ারিতে নরওয়েতে নিয়োজিত পশ্চিমা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তালেবান প্রতিনিধি দলের আলোচনার পর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। ওই বৈঠকে তালেবানকে বিদেশি সহায়তা প্রদান ও বিদেশে জব্দকৃত অর্থ উত্তোলনের সুযোগ দেওয়ার বিনিময়ে নারীদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিতের জন্য চাপ দেওয়া হয়েছিল।
বিদেশি সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আফগানিস্তানে মানবিক সংকট আরও বেড়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, ৯৫ শতাংশ আফগান নাগরিকই যথেষ্ট পরিমাণ খাবার খেতে পারছেন না।
মাজার–ই–শরিফের এক মেডিকেল শিক্ষার্থী বিবিসিকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়াটাই আর প্রধান অগ্রাধিকারের বিষয় নয়। আমরা ক্ষুধায় কাতর। আমার বাবা আগের সরকারের জন্য কাজ করতেন। তালেবান ক্ষমতায় আসার পর তিনি চাকরিহীন। খাওয়ার জন্য আমাদের কাছে কোনো খাবার নেই। নিশ্চিতভাবেই আমার বাবার পক্ষে আর আমার শিক্ষার খরচ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আমার বই, কাপড়চোপড় কেনা প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের কাছে কোনো অর্থকড়ি নেই।’
এরপরও আশা জিইয়ে রাখতে চান নারী শিক্ষার্থীরা
সর্বোপরি আফগানিস্তানে নারীদের উচ্চশিক্ষার পথটা এখনো অনিশ্চয়তায় ভরা। তবে এর মধ্যেও যাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরছেন, তাঁদের কাছে বাস্তব অগ্রগতি সম্পর্কে অনুভূতিটা মিশ্র রকমের।
তাখার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের পড়াশোনার অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়ায় আমার আনন্দ হচ্ছে ঠিকই, তবে সেখানে আমাদের নতুন বিধিনিষেধ মেনে চলতে হবে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে পুরুষ অভিভাবককে নিয়ে যাওয়ার মতো কিছু বিধিনিষেধ নিয়ে আমার অস্বস্তি হচ্ছে।’
আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে ফিরবেন বলে জানান ওই শিক্ষার্থী।
লার্ন আফগানিস্তান নামক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা পশতানা দুররানি। দেশটিতে এই সংগঠনের আওতায় বেশ কয়েকটি স্কুল পরিচালিত হয়। অনলাইনে নারী শিক্ষার্থীদের পাঠদানও করা হয়ে থাকে। বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, তালেবান ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তান ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেন দুররানি। তাঁর কাছে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার এই অনুভূতিটা মিশ্র।
শিক্ষক দুররানি কান্দাহারে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। তালেবানের সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত মনে হচ্ছে।
আমাদের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো উচিত। তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ায় দেশ ছাড়াতে বাধ্য হওয়া এক আফগান নারী হিসেবে আমি ব্যথিতও বোধ করছি।’
দুররানির ভাষ্য অনুযায়ী, উচ্চশিক্ষারত অবস্থায় তাঁর বন্ধুদের অনেককেই তাঁর মতো করে আফগানিস্তান ছাড়তে হয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হলেও অনেক ভালো মানুষকে হারিয়েছে দেশ।
নারী শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা অনিশ্চয়তার পরও শিক্ষার্থী রানা তাঁর পাঠে মনোযোগী হতে চান। তিনি বলেন, ‘আমার নারী সহপাঠীদের অনেককে প্রথম দিন দেখতে পাইনি। তবে আশা করছি, অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক নারী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার মতো নিরাপদ বোধ করবেন।’