শিরোনাম
নারীরা ঘরবন্দি। শিক্ষা, চাকরি, বাইরে বেরোনো সব বন্ধ। খেলা-ধুলা, শিল্প-সাহিত্য-সংগীত নিষেধ। বিজ্ঞানচর্চা ছুটিতে। ক্ষুধা আর দারিদ্র্য চরমে।
প্রায় দুই দশক আগে আফগানিস্তানের চিত্র যেমনটা ছিল। ২০২১ সালে সেই একই চিত্র আবারও ফিরে এসেছে এশিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে। তালেবানের শাসনে পড়ে সব হারানোর পথে আফগানরা।
২০২১ সাল আফগানদের জন্য একদিকে আশীর্বাদ সেই সঙ্গে অভিশাপও। এ বছরের ১৫ আগস্ট প্রায় দুই দশকের বিদেশি আগ্রাসন থেকে মুক্তি পেয়েছে দেশটি।
কিন্তু এক বিপদ থেকে মুক্ত হলেও আরেক বিপদ এসে ঘাড়ে চেপেছে। সেই নতুন বিপদ আর কিছু নয়-তালেবানি শাসন। বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের যতটুকু চর্চা শুরু হয়েছিল, নারীর ক্ষমতায়নের যে ধারার সূচনা হয়েছিল, তা তালেবানের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে থমকে গেছে। এ যেন ২০ বছরের পণ্ডশ্রম। ২০ বছর পেছনে ফিরে যাওয়া।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ নামে বিশ্বব্যাপী এক অনন্ত আগ্রাসনে নামে যুক্তরাষ্ট্র। ওই হামলার সন্দেহভাজন আলকায়েদাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে আফগানিস্তানে আগ্রাসন শুরু করে মার্কিন বাহিনী। সঙ্গে যোগ দেয় পশ্চিমারাও। এই আগ্রাসনের অল্প সময়ের মধ্যেই ক্ষমতাচ্যুত হয় তালেবান সরকার। কিন্তু তালেবান হটানোর পরও ‘আফগানিস্তান গঠন’র নামে ২০ বছর ধরে জবরদখল চলে। তবে শেষ পর্যন্ত সুবিধা করতে না পেরে এক রকম পালিয়ে গেল পশ্চিমারা।
শূন্যস্থান দ্রুত দখল করে সুযোগের অপেক্ষায় থাকা তালেবান। তবে তারা দাবি করেছিল, ক্ষমতায় এলে তাদের আর আগের রূপে দেখা যাবে না। ২০০১ সালের তালেবান, আর ২০২১ সালের তালেবান এক হবে না। কিন্তু না, তালেবান আগের মতোই রয়েছে। তাদের গত পাঁচ মাসের শাসনেই তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। দ্বিতীয় দফায় আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর এখন আফগান জনগণের ওপর একের পর এক কট্টরনীতি চাপিয়ে দিয়েছে তালেবান। অর্থনীতি আগের চেয়ে খারাপ হয়েছে। আফগানদের ঘরে বাসা বেঁধেছে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য।
ষাট, সত্তর বা আশির দশকে আফগান নারীদের রাস্তাঘাটে মুক্তভাবে বিচরণ করতে দেখা যেত। ছেলেদের মতো তারাও স্কুল-কলেজে যেতেন। পড়তেন মেডিকেল কলেজে। কম্পিউটর প্রশিক্ষণের ক্লাসে, শিক্ষকতায়, ব্যাংকে, চাকরিক্ষেত্রে-সবখানেই নারীদের সমান বিচরণ ছিল। নব্বই দশকের বছরগুলোতে দ্রুত নারীদের সেই উজ্জ্বল উচ্ছল চিত্র বদলে যেতে শুরু করে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ তালেবান শাসনামলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন আফগান নারীরা। মেয়েশিশুদের স্কুলে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নারীরা শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সুযোগ হারান।
বন্দি হন ঘরের চার দেওয়ালে। সেই সময় নারীদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ঢেকে বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। নিষিদ্ধ করা হয় পুরুষসঙ্গী ছাড়া ঘরের বাইরে যাওয়া। এসব নিয়ম না মানলে পাথর নিক্ষেপ, বেত্রাঘাত ও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার মতো কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। এ সময়ে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয় নারীর মৌলিক মানবাধিকার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্ম-সংস্থান, ক্ষমতায়নসহ সব ক্ষেত্রেই নারীরা পিছিয়ে পড়ে।
২০ বছরের ব্যবধানে তালেবানের চিন্তা-চেতনায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। ক্ষমতায় এসেই আগের মতোই তারা ঘোষণা করেছে, দেশ চলবে শরিয়াহ তথা ইসলামি আইনে। এবারও নারীদের ওপর নানাবিধ আরোপ করেছে। তবে এখন পর্যন্ত তাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলো কতটুকু ইসলামসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত পাঁচ মাসে অসংখ্য ডিক্রি বা নির্দেশনা জারি করেছে তালেবান সরকার। এর মধ্যে নারীরা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে পুরুষও। নারীবিষয়ক বিধিনিষেধের মধ্যে রয়েছে-নারীরা এখন থেকে বাইরে কাজ বা চাকরি করতে পারবে না। ইতোমধ্যে নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, নারীদের বিউটি পার্লার বন্ধ করা হয়েছে। নাটক-সিনেমা ও বিজ্ঞাপনে নারীদের অভিনয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নারী শিক্ষায় নতুন নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। ছেলে-মেয়েদের আলাদা ক্লাস। ক্ষমতা দখলের এক মাস পর সেপ্টেম্বরে নারী শিক্ষা নিয়ে নতুন নীতিমালা ঘোষণা করেন তালেবানের উচ্চশিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী আবদুল বাকি হাক্কানি। তিনি বলেন, আফগানিস্তানে মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবেন, তবে ছেলেদের সঙ্গে এক কক্ষে বসে নয়। এছাড়া মেয়েদের নির্দিষ্ট ড্রেসকোডও মেনে চলতে হবে।
গান-বাজনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেলুনে দাড়ি কামানো নিষেধ। সংগীতশিল্পী ও কৌতুকশিল্পীদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। এমনকি হত্যাও করা হচ্ছে। নারীদের খেলাধুলা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে নারী খেলোয়াড়রা দেশ ছাড়ছে। দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন সাবেক আইনজীবী ও বিচারকরাও। সর্বশেষ আফগানিস্তানে নারীদের ভ্রমণ নিয়ে নতুন নির্দেশনা দিয়েছে তালেবান সরকার। ঘনিষ্ঠ পুরুষ স্বজন ছাড়া তারা দূরবর্তী কোথাও ভ্রমণ করতে পারবে না। পুরুষসঙ্গী না থাকলে স্বল্প দূরত্বের ক্ষেত্রেও তাদের যানবাহন ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। এছাড়া কেবল হিজাব পরিহিত নারীদের যানবহনে উঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে পরিবহণ মালিকদের। ক্ষমতায় আসার পর গত কয়েক সপ্তাহেই আফগান অর্থনীতি তলানিতে ঠেকেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কাবুলের ক্ষমতা নেওয়ার পরই সবচেয়ে কঠিন দুই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তালেবান সরকার। এক. ভঙ্গুর অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। দুই. ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে আফগানদের বাঁচানো। কিন্তু এখন পর্যন্ত এক্ষেত্রে কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি সরকার। যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) আফগানিস্তানের প্রায় ৯৫০ কোটি ডলারের তহবিল গচ্ছিত রয়েছে। কিন্তু তালেবানের বারবার আবেদন-নিবেদন এখনো একটা কানাকড়িও দেয়নি। ফলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যে সাধারণ নাগরিকদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর রিপোর্ট মতে, ঠিকমতো বেতন পাচ্ছে না সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা।
লাখ লাখ আফগান দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা। দেশটির অন্তত ৬০ ভাগ মানুষ ভুগছে খাদ্য সংকটে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, দেশটিতে জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ আন্তর্জাতিক সাহায্য থেকে আসে। নতুন তালেবান সরকার আসার পর কমে গেছে সাহায্যের পরিমাণ। তালেবানের হাতে ক্ষমতা যাওয়ার পর থেকেই অর্থনৈতিক সংকট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। এছাড়া শীতে মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল আফগানদের আরও হুমকির মধ্যে পড়তে হবে বলেও সতর্ক করেছে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা। মধ্যপ্রাচ্যে গজিয়ে ওঠা ইসলামি স্টেট (আইএস) এক সময় ত্রাস সৃষ্টি করে গোটা বিশ্বে। কিন্তু কয়েকটি দেশের সম্মিলিত অভিযানে আইএস এখন প্রায় নিঃশেষ। তবে মধ্যপ্রাচ্যে সংগঠনটি নিঃশেষ হলেও এখন ভয়ংকর রূপে জানান দিচ্ছে আফগানিস্তানে।