শিরোনাম
সাম্প্রতিককালে দেখা যাচ্ছে, প্রথমে এশিয়া এবং পরে গোটা বিশ্বে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নে সি চিন পিংয়ের চীন অনেক বেশি আগ্রাসী, দৃঢ়সংকল্প।
ভারত ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের আলোচনায় গেলে সবার আগে আসবে সীমান্ত সমস্যা। ৩ হাজার ৪৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (এলএসি) সুনির্দিষ্ট চেহারা আজও দিতে পারেনি দেশ দুটি। এলএসি নিয়ে দুই দেশের চিন্তায় বিস্তর পার্থক্যও রয়েছে।
১৯৬০–এর দশকের শুরুতে তিব্বত দখল করার পর ভারতের বর্তমান অরুণাচল প্রদেশ ও ‘আকসাই চীন’কে নিজেদের অন্তর্ভুক্ত এলাকা বলে দাবি করে চীন। এভাবে যে সীমান্ত সমস্যার শুরু হয়, তা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের সূচনা করে। ১৯৬২ সালের ওই যুদ্ধে চীন জয়ী হয়ে একতরফা যুদ্ধবিরতি জারি করে, আকসাই চীন দখলে রাখে কিন্তু অরুণাচল প্রদেশ ভারতকে ফিরিয়ে দেয়। যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য ভারতকে সমর্থন দেয়। অন্যদিকে পাকিস্তান চীনের সঙ্গে মৈত্রী বাড়াতে সচেষ্ট হয়।
সীমান্তে উত্তেজনার পথ ধরেই ২০১৭ সালে ভুটানের ডোকলাম মালভূমিতে ভারত ও চীনা সেনার সংঘর্ষ হয়।
২০২০ সালের ১৫ জুন ভারত-নিয়ন্ত্রিত পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় ভারতের একটি সড়ক নির্মাণকে কেন্দ্র করে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের হাতাহাতি যুদ্ধে ২০ ভারতীয় জওয়ান প্রাণ হারান। চীনের তরফে মাত্র একজন সেনার প্রাণহানির কথা কবুল করা হয়। শুধু গালওয়ান নয়, অচলাবস্থা তৈরি হয় লাদাখের গালওয়ান, প্যাংগং লেকের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্ত, গোগরা, ডেপস্যাং, হটস্প্রিং—মোট ছয়টি এলাকায়। পূর্ব লাদাখের গোটা ঘটনা ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর দুটি দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে তলানিতে নামিয়ে আনে। আর জোরালো হয়ে ওঠে ভারতে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ। ডাক ওঠে চীনা পণ্য বর্জনের। কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের উসকানি, বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কর্কশ চিৎকার পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলে।
গত দেড় বছরে উভয় দেশের সেনারা কমান্ডার পর্যায়ে অন্তত ১২টি বৈঠক করেছেন। মধ্য জুলাইয়ে (২০২১) তাজিকিস্তানে সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশনের সম্মেলনে বৈঠক হয়েছে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও ওয়াং ইর মধ্যে। এতে ডেপস্যাং, হটস্প্রিং ছাড়া বাকি এলাকাগুলোতে উত্তেজনা হ্রাস পেয়েছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। সীমান্তে উভয় দেশই সৈন্য সরিয়ে নিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে ভারত সীমান্তে বিপুল পরিমাণ জমির দাবি পরিত্যাগ করেছে বলে আলোচনা আছে। অপর দিকে বাস্তবে সীমান্তে উত্তেজনা কমেনি মোটেও।
গালওয়ান উপত্যকার ঘটনায় চীনের মূলত উদ্বেগ ছিল ভারতের বাজার হারানোর শঙ্কা নিয়ে, অন্য কোনো বিষয়ে না। ভারত ওই সময় বেশ কিছু চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে। প্রসঙ্গত, ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলি সংস্থা বিএসএনএল এবং এমটিএনএল বিপুল পরিমাণ চীনা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে। বিএসএনএলে দুই চীনা সংস্থা জেডটিই ও হুয়েইয়ের যন্ত্রাংশের অংশীদারি যথাক্রমে ৪৪ এবং ৯ শতাংশ। রিলায়েন্স, আইডিয়াসহ বিভিন্ন বেসরকারি মোবাইল পরিষেবা সংস্থাও চীনা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনা যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের দিকে যাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ অবস্থায় ভারতে ‘জাতীয়তাবাদের বিস্তার’ ও রাজনৈতিক সরকারের ‘শক্ত অবস্থানের’ প্রেক্ষাপটে চীনের তরফে বিকল্প বাজার খোঁজার বিষয়েও আলোচনা হয়েছিল।
তবে সবকিছুই কি ছিল অভিনয়! সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালেই যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে আবার ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী দেশ হিসেবে উঠে আসে চীন। সীমান্ত বিরোধ পাশে ঠেলে রেখে চীনের সঙ্গে প্রায় ৭ হাজার ৭৭০ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক লেনদেন হয় ভারতের, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৫ লক্ষ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। মুখে যতই চাপান-উতোর থাকুক, ঘুড়ির মাঞ্জা থেকে দীপাবলির আলো, সবকিছুর জন্যই ভারতের সহায় প্রতিবেশী চীন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাণিজ্য ক্ষেত্রে দুই দেশের এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা শিগগিরই মিলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তবে সবকিছুই কি ছিল অভিনয়! সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালেই যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে আবার ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী দেশ হিসেবে উঠে আসে চীন। সীমান্ত বিরোধ পাশে ঠেলে রেখে চীনের সঙ্গে প্রায় ৭ হাজার ৭৭০ কোটি ডলারের বাণিজ্যিক লেনদেন হয় ভারতের, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৫ লক্ষ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। মুখে যতই চাপান-উতোর থাকুক, ঘুড়ির মাঞ্জা থেকে দীপাবলির আলো, সবকিছুর জন্যই ভারতের সহায় প্রতিবেশী চীন। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাণিজ্য ক্ষেত্রে দুই দেশের এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা শিগগিরই মিলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ভারত সুড়ঙ্গ নির্মাণে এগোতে না পারলেও চীন কিন্তু পিছিয়ে নেই। তিব্বতের রাজধানী লাসা থেকে অরুণাচল প্রদেশের সীমান্তবর্তী নিনচি পর্যন্ত বুলেট ট্রেন চালু করেছে দেশটি গত জুলাই মাসে। এই রেলপথকে পুরোদস্তুর সেনা পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা হবে। এর ফলে পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) সীমান্তবর্তী ওই প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুব সহজে পৌঁছে যেতে পারবে। ৪ হাজার ৫০০ মিটার উঁচু ওই অঞ্চলে বুলেট ট্রেনের মাধ্যমে প্রায় অর্ধেক সময়ে (সাড়ে তিন ঘণ্টা) গন্তব্যে পৌঁছাবে সেনা। এর মধ্যে সেনা পরিবহন শুরুও হয়ে গেছে। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ভারতের ওপরে চাপ বাড়াতেই এই কৌশল নিয়েছে চীন।
এ ছাড়া চীনা সেনারা পূর্ব লাদাখ সেক্টরের বিপরীতে আকসাই চীন এলাকায় নতুন রাস্তা তৈরি করছেন। এর ফলে তাঁরা দ্রুত ভারতের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে পৌঁছে যেতে পারবেন, এমন খবর ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে অতি সম্প্রতি।
এক বছর ধরে ডোকলামের কাছে ভুটানের ভূখণ্ড জবরদখল করে নির্মাণকাজ চালাচ্ছে চীন। সীমান্ত লাগোয়া ১০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকায় এই সময়ের মধ্যে ৪টি গ্রাম গড়ে তুলেছে তারা। চীন ও ভুটানের বিতর্কিত ভূখণ্ডে চীনের এই জবরদখল ভারতের পক্ষে উদ্বেগজনক বলেই মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।
সম্পর্কের তিনটি বিষয়
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব বিজয় গোখলে দুই দেশের সম্পর্কের এত অবিশ্বাসের কারণ হিসেবে গত দেড় দশকে ঘটে যাওয়া তিনটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। কার্নেগি ইন্ডিয়ায় গত বছরের ১০ মার্চ এ বিষয়ে তাঁর নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
এর প্রথমটি হলো ২০০৮ সালে চীন তার পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এনে বিশ্বব্যাপী তার ভূমিকাকে বিস্তৃত করার নীতি গ্রহণ করে। এই পদক্ষেপ ভারতের ওপর কী প্রভাব ফেলবে বা ফেলতে পারে, তা বিবেচনায় নেয়নি চীন। এ অবস্থায় ভারত চীনের এই নয়া নীতিকে দেখেছে বিশ্বব্যাপী তাঁর স্বার্থে আঘাত হিসেবে।
দ্বিতীয়ত, ভারতে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে পূর্বতন সরকারগুলো চীন ভারতকে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিত। কিন্তু মোদি এসে একদিকে যেমন এই সম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলেছেন, অন্যদিকে গুরুত্ব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রকে, যা চীন ইতিবাচকভাবে নিতে পারেনি।
তৃতীয়ত, ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের যৌথ নৌশক্তি বৃদ্ধির চেষ্টাও চীন ভালোভাবে নিতে পারেনি। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারত মহাসাগরে বিপুল আকারে শক্তি বৃদ্ধি করেছে চীন।
এ ছাড়া আঞ্চলিক রাজনীতিতেও ভারত একটু পিছিয়ে গেছে, বিদায়ী বছরে আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপটে। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিবেশী পাকিস্তান ও চীন তালেবান সরকারকে ‘সহযোগিতার নীতি’ গ্রহণ করে। অপর দিকে ভারত কিছুটা ভীত হয়ে পড়ে তাদের ভাষায় ‘সন্ত্রাসবাদ’ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায়। এমনকি নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে আফগানিস্তান নিয়ে ভারতের ডাকা বৈঠকে পাকিস্তান যোগ দেবে না আগেই বোঝা গিয়েছিল, অজুহাত তৈরি করে যোগ দেয়নি চীনও। চীনের যোগ দেওয়া ভারতের জন্য জরুরি ছিল। শেষ পর্যন্ত তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান আর রাশিয়াকে নিয়ে বৈঠক করতে হয়েছে ভারতকে।
আলোচনার দরজা বন্ধ থাকবে?
১৯৮৮ সালে চীনের নেতা দেং জিয়াওপিং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে বলেছিলেন, একুশ শতককে এশিয়ার শতক করে তুলতে ভারত-চীন সহযোগিতা আবশ্যক একটি শর্ত।
দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মনে হয়, ভারতের চিন্তাজুড়ে যতটা চীন রয়েছে, চীনের চিন্তায় আবার ততটা ভারত নেই। তা না থাকলেও প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক-বাহক এই দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপরেই গোটা এশিয়ার ঐক্য নির্ভর করছে। আর সন্দেহাতীতভাবে এই দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে যুক্ত রয়েছে একাধিক ‘তৃতীয় পক্ষ’। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, চীনের সঙ্গে পাকিস্তান আর ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, এই ‘সম্পর্কের’ বিষয়টি মেনে নিয়েই দুই দেশকে আলোচনার টেবিলে বসতে হবে। দুই দেশের রাজনৈতিক নেতাদের বিপুল প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে আসা মুক্ত আলোচনাই পারে অবিশ্বাস কমিয়ে পরস্পর আস্থা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি করতে।
সূত্র: বিবিসি, কার্নেগি ইন্ডিয়া ও আনন্দবাজার।