শিরোনাম
দীর্ঘদিন ধরে মানুষ মহাকাশে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন দেখেছে। তবে নভোচারীরা মহাকাশে যাওয়ার সুযোগ পেলেও, সাধারণ মানুষের জন্য এ সুযোগ এত দিন ছিল না। এ বছর থেকেই মহাকাশ পর্যটনের বিষয়টি বাস্তব রূপ পেয়েছে। যাঁদের পকেটে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রয়েছে, তাঁরা ইতিমধ্যেই মহাকাশে বেড়িয়ে আসার সাধ পূর্ণ করেছেন। এ তালিকায় রয়েছেন দুই ধনকুবের উদ্যোক্তা জেফ বেজোস ও রিচার্ড ব্র্যানসন। তাঁরা পর্যটক হিসেবে মহাকাশে ঘুরে এসেছেন। এর মাধ্যমে মহাকাশ পর্যটনের বিষয়টি পূর্ণতা পেয়েছে বলে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
মহাকাশ পর্যটনের দৌড়ে গত ১১ জুলাই প্রথমবারের মতো পর্যটক হিসেবে মহাকাশের প্রান্ত ঘুরে এসে ব্রিটিশ ধনকুবের রিচার্ড ব্র্যানসন বলেন, এটা একজীবনের অসামান্য অভিজ্ঞতা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা রিচার্ড ব্র্যানসন। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ নেওয়ার জন্য পরিচিতি রয়েছে তাঁর। তিন সহকর্মীকে নিয়ে মহাকাশ ঘুরে এসে মানুষের জয়যাত্রার নতুন মাইলফলকে নাম লিখিয়েছেন তিনি। ওই দিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো থেকে মহাকাশের উদ্দেশে যাত্রা করে ব্র্যানসনের মহাকাশ ভ্রমণ কোম্পানি ভার্জিন গ্যালাকটিকের নভোযান। বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্র্যানসনের রকেটটি ৫৩ মাইল (৮৫ কিলোমিটার) উচ্চতায় পৌঁছায়। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসার তথ্য অনুযায়ী, এই দূরত্ব মহাকাশের সীমার চেয়ে বেশি। এ দূরত্বে গেলে যাত্রীরা ওজনহীনতার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন। এ যাত্রার মধ্য দিয়ে মহাকাশ পর্যটনের ইতিহাস গড়েন রিচার্ড ব্র্যানসন।
বিবিসি জানায়, মহাকাশযাত্রায় ব্র্যানসনের সঙ্গে ছিলেন পাইলট ডেভ ম্যাকে ও মাইকেল মাসুকসি। অন্য তিনজন হলেন গ্যালাকটিকের কর্মী বেথ মসেস, কলিন বেনেট ও শ্রিসা বান্ডলা। আগামী বছর থেকে তিনি আগ্রহী যাত্রীদের কাছে টিকিট বিক্রি করবেন। ইতিমধ্যে ভার্জিন গ্যালাকটিকের কাছে যাত্রী হিসেবে ৬০০ ব্যক্তি অগ্রিম টিকিটের ফরমাশ দিয়ে রেখেছেন। এক ঘণ্টার এই অভিজ্ঞতা নিতে খরচ হবে আড়াই লাখ মার্কিন ডলার বা ২ কোটি ১১ লাখ টাকার বেশি। এ যাত্রায় পাঁচ মিনিটের মতো ওজনহীনতার অভিজ্ঞতা ও পৃথিবীর দিগন্ত দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে।
এদিকে ব্র্যানসনের মহাকাশযাত্রার কাছে হার মানেননি আমাজনের ২০০ বিলিয়ন ডলারের মালিক জেফ বেজোস। ৯ দিন পরেই ৬৫ মাইল ওপরে ঘুরে এসে মহাকাশ বিজয় দাবি করেন তিনি। আমাজনের তরফে বলা হয়, পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডল ও মহাকাশের কাল্পনিক সীমা কারমান লাইন নামে পরিচিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৬২ মাইল ওপরের যে কারমান লাইনের অবস্থান, তা অতিক্রম করেছিল বেজোসের নভোযান।
বেজোসের মহাকাশ সংস্থা ব্লু অরিজিনের সঙ্গে ভার্জিন গ্যালাক্টিকের প্রতিযোগিতার ফলে মহাকাশযাত্রা আরও সুলভ হতে যাচ্ছে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
আকর্ষণীয় বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন
এ দশকের শেষেই অবসরে যাবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন, কিন্তু তার আগেই মহাকাশ পর্যটন শুরু করতে তোড়জোড় করে বানানো হচ্ছে বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন। এতে সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা। বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশন তৈরিতে তিনটি সংস্থাকে কয়েক কোটি মার্কিন ডলার তহবিল সরবরাহ করছে নাসা। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের বিকল্প হিসেবে বাণিজ্যিক মহাকাশ স্টেশনগুলো ব্যবহার করা যাবে। নাসার অর্থায়ন পাওয়া সংস্থাগুলো হচ্ছে মার্কিন ধনকুবের জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিন, মহাকাশ সংস্থা ন্যানোর্যাকস ও প্রতিরক্ষা ঠিকাদার নর্থরপ গ্রুমান। প্রতিষ্ঠান তিনটি মহাকাশ স্টেশন গড়তে যথাক্রমে ১৩ কোটি, ১৬ কোটি ও ১২ কোটি ৫৬ লাখ মার্কিন ডলার অর্থায়ন পেয়েছে। এর আগে অ্যাক্সিওম স্পেস নামের আরেকটি কোম্পানিকে নাসা ১৪ কোটি মার্কিন ডলার অর্থায়ন করেছে।
আগে নাসা নিজে থেকে বিভিন্ন হার্ডওয়্যার তৈরিতে কাজ করলেও, ধীরে ধীরে তারা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে। খরচ সাশ্রয় করার পাশাপাশি উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জনের জন্যই এ পথে হাঁটতে হচ্ছে সংস্থাটির। নাসার উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে চাঁদে বসতি স্থাপন ও মঙ্গল গ্রহে নভোচারী পাঠানোর মতো নানা বিষয়।
নাসার প্রধান বিল নেলসন এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমরা মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মহাকাশে স্টেশন তৈরির জন্য অংশীদার হচ্ছি, যাতে সেখানে ভ্রমণ, বসবাস ও কাজ করা সম্ভব হয়। এর মাধ্যমে নাসা মহাকাশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম উত্সাহিত করার পাশাপাশি মানুষের সুবিধার জন্য নানা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে।’
নাসার বাণিজ্যিক মহাকাশযাত্রার পরিচালক ফিল ম্যাকঅ্যালিস্টার বলেন, এ পুরস্কার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মহাকাশে অবিচ্ছিন্ন মানব উপস্থিতি নিশ্চিত করতে সহায়তা করবে। এ ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের শূন্যতা ভালো কিছু হবে না।
ব্লু অরিজিন নামের প্রতিষ্ঠানটি আরেক মহাকাশ সংস্থা সিয়েরা স্পেসের সঙ্গে মিলে ‘অরবিটাল রিফ’ নামের মহাকাশ স্টেশন তৈরি করছে। এ দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এ মহাকাশ স্টেশন তৈরি হবে। এতে ১০ জনের আবাসন–সুবিধা থাকবে। অরবিটাল রিফকে মহাকাশে ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এ ছাড়া এ স্টেশন থেকে মাইক্রোগ্র্যাভিটি নিয়ে গবেষণা ও মহাকাশের উপযোগী নানা যন্ত্রাংশ তৈরির কাজ করা যাবে।
মহাকাশ সংস্থা ভয়েজার স্পেস ও লকহিড মার্টিনের সঙ্গে মিলে ন্যানোর্যাকস ‘স্টারল্যাব’ নামে মহাকাশ স্টেশন তৈরি করছে। ২০২৭ সালে এ স্টেশন তৈরি হতে পারে। এতে থাকবে একটি জীববিদ্যা ল্যাব, উদ্ভিদের বাসস্থান ল্যাব, ভৌতবিজ্ঞান, গবেষণাগার ও ওয়ার্কবেঞ্চ এলাকা।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে কার্গো সরবরাহ করতে ‘সিগনাস’ নামে মহাকাশযান তৈরি করেছে নর্থরপ গ্রুমান। সংস্থাটি বিভিন্ন মডিউল একত্র করে মহাকাশ স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা করেছে। এতে থাকবে বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন গবেষণার সুযোগ ও পর্যটনসুবিধা। মহাকাশ স্টেশন তৈরিতে মোট খরচের কোনো ধারণা অবশ্য দেয়নি সংস্থাগুলো। তবে ম্যাকঅ্যালিস্টার বলেন, মহাকাশ স্টেশন তৈরিতে ৪০ শতাংশের বেশি অর্থায়ন করা হবে না।
তবে ব্লু অরিজিন কর্তৃপক্ষ বলেছে, প্রাথমিকভাবে যে অর্থায়ন করা হয়েছে, তা মোট খরচের সামান্যই।
আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটিকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত নিরাপদ বলে মনে করা হচ্ছে। নাসার প্রধান নেলসন আরও বলেন, তিনি আশা করছেন, ২০৩০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনটি কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। এ সময়ের মধ্যেই বাণিজ্যিকভাবে এর বিকল্প তৈরি করতে চাইছে নাসা।
মহাকাশে প্রতিযোগিতা
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন মহাকাশ অবধি বিস্তৃত হয়ে গেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা নাসার পারসেভারেন্স রোবট প্রথম মঙ্গলের মাটি স্পর্শ করে। এ ছাড়া মঙ্গলের মাটিতে প্রথমবারের মতো ইনজেনুইটি নামের হেলিকপ্টার ওড়াতে সক্ষম হয় নাসা। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মে মাসেই ঝুরং নামে একটি রোবট মঙ্গল গ্রহে পাঠায় চীন। সেটি মঙ্গলের উত্তরাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় অবতরণ করে। এতে একটি সুরক্ষাধর্মী ক্যাপসুল, একটি প্যারাস্যুট ও একটি রকেট প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। এর আগে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছিল মঙ্গলের মাটিতে অবতরণের গৌরব। তাতে ভাগ বসিয়েছে চীন। এদিকে মহাকাশে সিনেমার শুটিংয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে রাশিয়া। মহাকাশ ভ্রমণ নিয়ে চলচ্চিত্রের বিষয়টি একেবারে নতুন না হলেও, মহাকাশে শুটিংয়ের বিষয়টি নতুন। রাশিয়ার একদল চলচ্চিত্র নির্মাতা এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে গিয়ে ‘দ্য চ্যালেঞ্জ’ নামের একটি চলচ্চিত্রের শুট করেছেন।
মিশন মঙ্গল
চীন মঙ্গলে যেতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র অনেক দিন ধরেই মার্স মিশন নিয়ে আছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতও এ বছর মঙ্গল মিশন শুরু করেছে। তবে মঙ্গল গ্রহ নিয়ে আকর্ষণ থাকলেও আদৌ মানুষ বসতি স্থাপন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ভবিষ্যৎই জানাবে মানুষ দ্বিতীয় পৃথিবীর সন্ধান পাবে কি না। তবে মহাকাশ পর্যটন যেভাবে বাড়তে শুরু করেছে, একদিন হয়তো মানুষ মঙ্গল গ্রহে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করবে। সেখানে বসতিও গড়বে। সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়।
এএফপি, রয়টার্স ও নিউইয়র্ক টাইমস অবলম্বনে