শিরোনাম
সুগন্ধ আর রংয়ের জন্য বিশ্বজুড়ে প্রাচীনকাল থেকেই বেশ কদর রয়েছে জাফরানের। মহাবীর আলেকজান্ডারও জাফরানের সুগন্ধে বিভোর ছিলেন। তিনি জাফরান মেশানো চা পান করতেন, ভাতের মধ্যেও খেতেন জাফরান। এমনকি জাফরান মেশানো জলে গোসল করতেন।
রোমান নব দম্পতিরা তাদের বিছানায় সুগন্ধ ছড়ানোর জন্যও ব্যবহার করতেন জাফরান। তবে আজকের জগতে জাফরান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় খাবার পরিবেশনে। বিশ্বের অন্যতম দামি মসলা জাফরান, যা একই সঙ্গে খাবারের প্রতি আকর্ষণ বাড়ায় এবং সুগন্ধ ছড়ায়। জাফরানে ওষুধি গুণ থাকায় খাবার ছাড়াও আরও বিভিন্ন কাজে এর ব্যবহার হয়ে থাকে।
ক্রোকাস সেটিভাস নামে একটি ফুলের আঁশ এই জাফরান। এর আদিনিবাস হলো গ্রিসে। ধীরে ধীরে জাফরানের চাষ ইরানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ইরান বিশ্বে ৯০ শতাংশ জাফরান রপ্তানি করে। ব্রিটেনের এক আমদানিকারক গত নভেম্বরে ইরান থেকে এক কিলোগ্রাম জাফরান আমদানি করেন। এর বাজার মূল্য ছিল ১৪শ মার্কিন ডলার বা ১ লাখ ২০ হাজার টাকার বেশি।
জাফরানের সুগন্ধ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিলেও ভালো নেই ইরানের জাফরান ব্যবসায়ীরা। কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিন পার করছেন তারা। করোনা মহামারির মধ্যে বিশ্বজুড়ে জাফরানের চাহিদা বাড়লেও সময়মতো সরবরাহ করতে পারেননি এই ব্যবসায়ীরা।
দেশটিতে খরা, শিপিং ও শ্রমের খরচ বেড়ে যাওয়া, পরিবহণে কালক্ষেপণসহ নানা জটিলতার মধ্যে পড়েছেন জাফরান ব্যবসায়ীরা। এছাড়া, পরমাণু ইস্যুতে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্ব অর্থনীতি থেকে ছিটকে পড়ছে ইরান। ফলে অন্য কোনো বিকল্প উপায় খুঁজছেন জাফরান ব্যবসায়ীরা। এতে তাদের দালালদের খপ্পড়ে পড়তে হয়, অস্বচ্ছ উপায়ে সরবরাহ করতে হয়। পেমেন্টের ক্ষেত্রেও জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন ইরানের জাফরান ব্যবসায়ীরা।
এক কেজি জাফরান কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ইরানের সবচেয়ে বেশি জাফরান উৎপাদনকারী অঞ্চল খোরাসান থেকে চলে যায় দুবাই বা স্পেনে। অনেক সময় ওজন বাড়ানোর জন্য এতে অন্য কিছু উপাদানও মেশানো হয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে স্প্যানিশ পুলিশ একটি চোরাচালান আটকে চারশ কেজি জাফরান জব্দ করে। ইরান থেকে আমদানির পর এতে সস্তা উপাদান যোগ করা হয়েছিল বলে জানা যায়।
এসব কারণে ইরানের সত্যিকারের জাফরান ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়ছেন। ইরানের একজন রপ্তানিকারক ভাহিদ জাফারি। তিনি সবেমাত্র ভিয়েতনামের একজন ক্লায়েন্টের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমাকে আমার গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের জন্য আরও বেশি চেষ্টা করতে হবে। তিনি আরও জানান, ভিয়েতনামের ওই ক্লায়েন্ট তাকে বলেন, তারা আসলে নকল জাফরান সরবরাহ নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইরান থেকে জাফরান নিতে অন্য গ্রাহকরাও ভয় পাচ্ছেন, বিশেষ করে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে সরবরাহ নিয়ে। কারণ তারাও আমেরিকার কালো তালিকাভুক্ত হবে। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার কারণে আমদানিকারকরাও ভয়ের মধ্যে থাকেন।
ব্রিটেনের এক আমদানিকারক বলছিলেন, তার দুবাই ও ব্রিটেনের ব্যাংক একাউন্ট বন্ধ। প্রতি ছয় মাস পরপর বার্কলেস নামে একটি ব্রিটিশ ব্যাংক তাকে জিজ্ঞেস করে, তিনি ইরানের সঙ্গে ব্যবসা করেন কিনা। তিনি বলেন, আমাকে এ বিষয়ে মিথ্যা বলতে হয়।
ইরানের জন্য আগে এমন কঠিন পরিস্থিতি ছিল না। বিশেষ করে ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য সহজ করা হয়েছিল। সে সময় ইরান বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার শর্তে তাদের পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত রাখতে সম্মত হয়। কিন্তু তিন বছর পর, ২০১৮ সালে যখন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।
২০১৫ সালের সেই পরমাণুবিষয়ক চুক্তি পুনরুদ্ধার করার জন্য আলোচনা চলছে ভিয়েনায়। যদিও এখন পর্যন্ত আলোচনার অগ্রগতি খুবই কম। তবুও এটি ইরানের ব্যবসায়ীদের মনে আশা জাগানিয়া ব্যাপার বলা যায়। তেহরানের এক জাফরান ডিলার বলছিলেন, যদি বর্তমানে আপনি ইরান থেকে জাফরান রপ্তানি করতে পারেন তাহলে আপনি একজন সুপারম্যান।
সূত্র: দ্যা ইকনোমিস্ট