শিরোনাম
ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এখন চোখে পড়ার মতো। উন্নয়ন আর সম্ভাবনার দিক থেকে বিশ্বে স্থায়ী আসন গেড়ে বসতে শুরু করেছে দেশটি, যা অন্যদের জন্যও শিক্ষণীয় বৈকি। ভূ-তাত্ত্বিক অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এবং নিজেদের স্বতন্ত্র মনে করাকে পাকাপোক্ত করছেন ভিয়েতনামের উদ্যোক্তারা। সেকারণে দেশে কিংবা দেশের বাইরে থেকে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছেন তারা।
ফলে দিনকে দিন ফুলেফেঁপে উঠছে ভিয়েতনামের দেশীয় বাজার ব্যবস্থা। দেশের আর্থিক অবস্থানকে বিশ্বের কাছে অনন্য করে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর ভিয়েতনামের বিনিয়োগকারীরা। আর তাই বিশ্বজুড়ে বিলিয়নিয়ারের তালিকায় একের পর এক যুক্ত হচ্ছে ভিয়েতনামের উদ্যোক্তাদের নাম।
ভিয়েতনামের হোল্ডিং ফার্ম সোভিকো চলতি মাসের শুরুতেই ২০৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দেওয়ার পর ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ডের লিনাক্রে কলেজ (স্নাতক ছাত্রদের জন্য) পুনরায় নামকরণ করা হচ্ছে। এর চেয়ারম্যান নগুয়েন থি ফুওং থাও।
২০১২ সালেও ভিয়েতনাম বিলিয়ন ডলারের ক্ষেত্র ছিল না। ফোর্বস ম্যাগাজিনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বিলিয়নিয়ারের ক্লাবে যুক্ত হয়েছেন ছয় ভিয়েতনামি। একটি ক্রমবর্ধমান স্টকমার্কেট অর্থাৎ এই তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে। যেখানে আমেরিকান এবং চীনের বিলিয়নিয়াররা অনেকটা সরকারের নানা বিধিনিষেধের মধ্যে থাকেন সেখানে ভিয়েতনামের বিনিয়োগকারীরা একটি সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক এবং সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পান। এ কারণে ভিয়েতনামের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জাতীয় চ্যাম্পিয়নরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে ওঠেন।
বিলিয়নিয়ারের শীর্ষদের তালিকায় রয়েছেন একটি নামকরা বহুজাতিক কোম্পানি ভিনগ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ফাম নাট ভুয়ং। ২০১৩ সালে তিনিই প্রথম বিলিয়নিয়ার ক্লাবে প্রবেশ করেন। পর্যটন থেকে হাসপাতাল, ফার্মেসি থেকে শিক্ষা, শিক্ষা থেকে গাড়ি তৈরি পর্যন্ত ভিনগ্রুপ ছুঁয়ে যায়নি এমন কোনো দেশীয় পরিষেবা খাত খুঁজে পাওয়া কঠিন। ২০১৮ সালে এটির ভিনহোমস বাজার মূলধনের ভিত্তিতে ভিয়েতনামের বৃহত্তম প্রাইভেট ফার্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়, যার শেয়ার মূল্য ১৫ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি।
ভিয়েতনামের ভুয়ংয়ের পর থাওসহ আরও অনেক ধনকুবের যোগ দিয়েছেন বিলিয়নিয়ার ক্লাবে। মাসান গ্রুপ, একটি ভোক্তাকেন্দ্রিক বহুজাতিক কোম্পানি এবং টেককমব্যাংক, দেশের অন্যতম বৃহত্তম ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নগুয়েন ড্যাং কোয়াং এবং হো হুং আনও রয়েছেন এই তালিকায়। এই চারজনই তাদের উদ্যোক্তা হওয়ার শুরুর রোমাঞ্চকর গল্পটা শেয়ার করেছেন। তারা মূলত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে বাণিজ্যিক উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
ভিয়েতনামের আধুনিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৮৫ সালে ভিয়েতনামের মাথাপিছু জিডিপি ছিল বর্তমানে ৫০০ ডলারের সমান, সেটি তখন বিশ্বের সবচেয়ে কম। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ভিয়েতনামের মেধাবী ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষার্থীরা রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অধ্যয়নের সুযোগ পান। ১৯৮০ সালের মধ্যে বিশেষ করে কমিউনিস্ট অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে আসা এই সংখ্যা ছিল তিন হাজারের মতো।
মূলত সাবেক সোভিয়েত অঞ্চল থেকে তারা উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ পান। পরে ১৯৮০ এবং ১৯৯০ সালের শুরুর দিকে ভিয়েতনামে স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ তৈরি হয় তাদের। ভুয়ং একটি ইনস্ট্যান্ট নুডলস মিভিনা দিয়ে ইউক্রেনে শুরু করেছিলেন ব্যবসা। পূর্ব এশিয়া থেকে অফিসিয়াল সরঞ্জাম ও কনজ্যুমার পণ্য আমদানি করে থাও তার প্রথম মিলিয়ন ডলার হওয়ার সুযোগ গড়ে তুলেছিলেন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। এরপর থেকে বলা চলে ভিয়েতনামের উন্নয়ন অব্যাহত থাকে।
এই বিলিয়নেয়াররা সৌভাগ্যবান যে বাইরে থেকেও নিজ দেশে বিনিয়োগের সুযোগ পান। দ্রুতবর্ধনশীল ভিয়েতনামকে নিয়ে লেখা একজন লেখকের মতে, তথাকথিত ‘পূঁজিপতি দেশপ্রেমিক’ মনে করা হলেও ভিয়েতনাম সরকার তাদের স্বাগত জানিয়েছিল। তিনি মনে করেন, তারা যখন এগিয়ে যাচ্ছিলেন, রাষ্ট্রেরও তাদের প্রয়োজন ছিল, ফলে এটিকে তিনি একধরনের মিথোজীবীতার সম্পর্ক হিসেবে দেখেন।
সম্প্রতি ধনকুবেরদের সঙ্গে ভিয়েতনাম রাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নগুয়েন জুয়ান ফুক বলেন, ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে আরও বেশি ব্যবসায়ী জায়ান্ট তৈরি করা দরকার।
রাষ্ট্রের সঙ্গে উদ্যোক্তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ভিয়েতনামের উন্নয়ন আরও ত্বরান্বিত হবে, যদিও এটি চীনের অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হংকংয়ের মতো। ফুলব্রাইট ইউনিভার্সিটি ভিয়েতনামের নগুয়েন জুয়ান থানের গবেষণা অনুযায়ী, দেশটির বেশিরভাগ বিলিয়নিয়ার উঠে আসেন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে, যাদের বেশিরভাগ আর্থিক খাত নিজস্ব সম্পত্তি ও ব্যাংকিং। বাইরে থেকে বিনিয়োগ আনতে গেলে তাদের অনুমোদন, লাইসেন্স এবং রাজনৈতিক সুসম্পর্কের প্রয়োজন পড়ে।
বিনিয়োগ বাড়লে দেশীয় ব্যবসার প্রসার ঘটে বহুগুণে, একই সঙ্গে বাড়ায় আস্থা। চলতি মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার সবচেয়ে বড় বহুজাতিক কোম্পানি এসকে গ্রুপ ঘোষণা দিয়েছে, ৩৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে ভিয়েতনামের মাসান গ্রুপে। যেখানে চীনের প্রযুক্তি জায়ান্ট আলিবাবার ৪০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের খবর জানা যায় আগেই। ভিয়েতনামের ভিনগ্রুপেও এসকের ৬ শতাংশ মালিকানা রয়েছে।
দুর্নীতির দায়ে এশিয়া কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নগুয়েন ডুক কিয়েন এবং ওশানব্যাংকের চেয়ারম্যান হা ভ্যান থামকে ২০১৪ এবং ২০১৭ সালে দীর্ঘদিন ধরে জেল খাটতে হয়েছিল। থামের ডেপুটিকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল একই সময়। সুতরাং শুধু ভিয়েতনাম নয়, গোটা বিশ্বে বিনিয়োগকারীদের সরকারের সুনজরে থাকলে যেমন উপকার হয় ঠিক তেমনি ঝুঁকিও রয়েছে।
সূত্র: দ্যা ইকোনমিস্ট