শিরোনাম
হঠাৎ দেখলে মনে হবে কেউ যেন জাদুবলে গ্রামের বেশিরভাগ মানুষকে অদৃশ্য করে দিয়েছে! ফাঁকা ঘরবাড়িতে রয়ে গেছে আতঙ্কের রেশ। কিন্তু কেন? কী কারণে খাঁ খাঁ করছে ভারতের উত্তর প্রদেশের ওই গ্রাম? এজন্য দায়ী ‘রহস্যময়’ এক জ্বর। এরই মধ্যে ১২ জনের প্রাণ কেড়েছে এই ব্যাধি। অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী আরও অর্ধশতাধিক। তাই তো দলে দলে পালিয়ে যাচ্ছেন কানপুর নগর জেলার কুরসৌলি গ্রামের বাসিন্দারা। সূত্র: জাগো নিউজ
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস রোববার (১৯ সেপ্টেম্বর) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে শুধু পুরুষরা থেকে গেছেন। নারী ও শিশুদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে অন্য এলাকায়। বেশিরভাগ বাড়ির ঘরই তালাবন্দি। গ্রামজুড়ে যেন ছড়িয়ে রয়েছে কোনো অলক্ষুণে ছায়া!
কানপুর শহরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন অনিল কুমার। তিনি জানান, তার স্ত্রী-সন্তানকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন, কেবল নিজে থেকে গেছেন বাড়ির মহিষগুলো দেখাশোনার জন্য। বছর চল্লিশের ওই ব্যক্তি বলেন, গবাদিপশু আর খামার না থাকলে পুরো গ্রামই খালি হয়ে যেতো। এমন একটি বাড়িও নেই যেখানে জ্বর পৌঁছায়নি। অনেকে আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেছেন। কেউ কেউ আশপাশের এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন।
গত ২০ আগস্ট রহস্যময় জ্বরে মারা যায় তান্নু প্রজাপতি নামে ১৪ বছরের এক কিশোরী। সেই থেকে শুরু। এরপর একে একে প্রাণ গেছে আরও ১১ জনের, যাদের মধ্যে নয়জনই মেয়ে অথবা নারী।
কানপুর নগর জেলার অতিরিক্ত চিফ মেডিকেল অফিসার (সিএমও) ডা. সুবোধ প্রকাশ স্বীকার করেছেন, তারা এখনো এসব মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে পারেননি। তিনি বলেন, মৃতদের বেশিরভাগেরই ডেঙ্গু অথবা ম্যালেরিয়া পরীক্ষা হয়নি। যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল, সবাই সুস্থ হয়ে গেছেন। পরীক্ষায় এখনো একজনও ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া যায়নি।
মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে জানিয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, আশপাশের গ্রামগুলোতে এমন সমস্যা নেই।
রহস্যময় জ্বরে মারা যাওয়া তান্নুর বাবা দিনমজুর। মেয়েটির বোন জানায়, পরিবারের অন্তত চারজনের জ্বর এসেছিল। তান্নু অসুস্থ হয়ে পড়ে গত ১৮ আগস্ট, পরে হাসপাতালে নিতে নিতেই মারা যায় সে। তবে তাদের পাঁচ বছর বয়সী ভাই সুস্থ হয়ে উঠেছে।
প্রদ্বীপ তিওয়ারি নামে মধ্যবয়সী এক কৃষক জানান, গ্রামের ১৮০টি বাড়ির মধ্যে অন্তত ৫০টিতেই তালা দেওয়া। জ্বরে মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে তার চাচি ও ভাবি মারা গেছেন। ঘরের ভেতর অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছেন ৭০ বছর বয়সী চাচা। তাকে অস্কিজেন দিতে হচ্ছে।
জ্বরে মারা গেছেন গ্রামপ্রধান অমিত সিংয়ের চাচিও। তিনি জানান, চাচির মৃত্যুতে তারা খুবই অবাক হয়েছিলেন। অমিত বলেন, চাচি পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন। তিনদিন আগে জ্বর আসলে আমরা তাকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাই। অবস্থার অবনতি হলে চাচিকে আরেকটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেই মারা যান তিনি।
রহস্যময় জ্বরে মারা যাওয়া কনিষ্ঠ মানুষটি হচ্ছে ১১ বছরের শিশু বৈষ্ণবী। সেও অসুস্থ হওয়ার মাত্র তিনদিনের মধ্যে মারা যায়। বৈষ্ণবীর মা মোহিনী গুপ্ত বলেন, তার (বৈষ্ণবী) পেটে ব্যথা ছিল, বমি হচ্ছিল ও খুব জ্বর এসেছিল। আমার ছোট ছেলেও অসুস্থ হয়েছিল, তবে সে সুস্থ হয়ে উঠেছে।
শুধু সন্তান হারানোই নয়, এমন শোকের মধ্যে টয়লেট বানাতে সরকারি কর্মকর্তা চাপ দিচ্ছেন বলে ক্ষোভপ্রকাশ করেন মোহিনী। তিনি জানান, পাকা টয়লেট না বানালে মামলা করার হুমকি দিয়ে গেছেন সরকারি কর্মকর্তারা।
গত ৫ সেপ্টেম্বর মারা যাওয়া আরেক নারীর পরিবারও অভিযোগ করেছে, পাকা টয়লেট বানানোর জন্য তাদের আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে।
কল্যাণপুর কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, তারা গ্রামবাসীকে টয়লেট বানানোর ‘অনুরোধ’ জানিয়েছেন। তাদের বিশ্বাস, এই সংক্রমণের পেছনে নোংরা পানি আটকে থাকার ভূমিকা থাকতে পারে।
ওই কর্মকর্তা বলেন, গ্রামে নর্দমার ব্যবস্থা নেই। লোকজন খোলা ড্রেনে আবর্জনা ফেলে। আমরা ৩০টি পরিবারকে শিগগির ঠিকঠাক টয়লেট বানাতে নোটিশ দিয়েছি। এ বিষয়ে প্রকাশ্য ঘোষণাও করা হয়েছিল।
অতিরিক্ত সিএমও প্রকাশ বলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে আমরা ফগিং, স্প্রেসহ অন্যান্য কাজ করছি। মানুষজনকে এ বিষয়ে সচেতন করতে নিয়মিত প্রচারণাও চালাচ্ছি।
তবে কুরসৌলি গ্রামবাসীর ভয়, শিগগির হয়তো অন্য গ্রামের মানুষেরা তাদের বয়কট করতে শুরু করবে। দশরথ নামে এক দিনমজুর বলেন, পাশের গ্রামের লোকেরা আমাদের এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। জ্বরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসলে খুব শিগগির নিকটবর্তী গ্রামে আমাদের জন্য কাজ পাওয়া কঠিন হতে পারে।