শিরোনাম
গত সোমবারের ঘটনা। নটিংহ্যামের একটি নাইটক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন লিজি উইলসন। আচমকা পিঠে সূক্ষ্ম একটা ব্যথা টের পেলেন। বুঝতে পারলেন কেউ একজন সুচ বিঁধিয়েছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আততায়ী চলে গেলো আড়ালে। মিনিট দশেক পরই উইলসন টের পেলেন তিনি পা নাড়াতে পারছেন না। টলতে টলতে কোনোমতে ডাক দিলেন বন্ধুদের। তারাই এগিয়ে এসে উদ্ধার করে তাকে।
উইলসন আগে থেকেই জানতেন তরুণীদের টার্গেট করে ইদানীং ক্লাবগুলোর আশপাশে এভাবে চেতনানাশক ইনজেকশন পুশ করা হচ্ছে। তাই দেরি না করে বন্ধুদের বললেন, দ্রুত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কারণ তিনি জানেন, একটু পরই তার পুরো শরীর অবশ হয়ে পড়বে।
‘এমন পরিস্থিতিতে কাউকেই যেনও যেতে না হয়।’ নটিংহামের কলেজপড়ুয়া উইলসন জানালেন নিউ ইয়র্ক টাইমসকে। বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছিল, আমার নিজের ওপর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।’
গত এক বছর ধরেই ব্রিটেনে তরুণীদের ওপর সহিংসতা বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। অপহরণ, খুন- এসবই এখন দেশটির বড় ইস্যু। এমনকি বিভিন্ন স্থানে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদও হচ্ছে। নাইটক্লাব কিংবা রাতে ঘুরতে বের হওয়া উঠতি বয়সী মেয়েদের টার্গেট করে এমন হামলা চালানোর নেপথ্যে কেউ দায়ী করছেন সম্প্রতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা করোনা-পরবর্তী অপসংস্কৃতিকে।
এর আগে কিশোরী ও তরুণীদের গায়ে এভাবে সুচ ফোটানোর বিষয়টি ছিল বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এখন একই ধরনের ভিকটিমের সংখ্যা বাড়ছেই। শুধু নটিংহ্যাম্পশায়ারেই সম্প্রতি এমন ১২টি ঘটনা ঘটেছে। স্কটল্যান্ডের পুলিশের কাছেও আসছে এমন ঘটনার (স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হচ্ছে স্পাইকিং) অভিযোগ।
স্পাইকিংয়ের শিকার তরুণীরা বেশি হলেও, কিছু তরুণও এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন। নটিংহ্যাম্পশায়ার পুলিশ বলছে, ইনজেকশন পুশ করেই সটকে পড়ছে আততায়ী। এখন পর্যন্ত এমন কোনও ঘটনার সঙ্গে কোনও ধরনের যৌন নির্যাতনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। আততায়ীরা মূলত নাইটক্লাবগুলোকে টার্গেট করেই এ কাজটা করছে।
নারী অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন নটিংহ্যাম্পশায়ারের সাবেক পুলিশ প্রধান সু ফিশ। তিনি জানালেন, ‘আচরণের এরচেয়ে অবনতির কথা ভাবা যায় না। এমন ঘটনার শিকড় আরও গভীরে গাঁথা।’
ইউনিভার্সিটি অব লিভারপুল-এর অধ্যাপক ও সেখানকার অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ফিয়োনা মিশাম জানালেন, “জাতীয় পর্যায়ে প্রতি বছরই কয়েকশ’ স্পাইকিংয়ের ঘটনা ঘটে থাকে। এর ঝুঁকি এখনও কম হলেও প্রতিটি অভিযোগকেই গুরুত্ব দিয়ে আলাদাভাবে তদন্ত করতে হবে। আমার মনে হয় এখানে ভীতিটা কাজ করছে বেশি। নাইটক্লাবগুলোর প্রতি ক্ষোভটাও এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না।”
দেশটির হোম অ্যাফেয়ার্স সিলেক্ট কমিটির প্রধান ইভেট কুপার জানালেন, ‘সমস্যাটার মাত্রা কতটা তা নিয়ে এখনও বাস্তবধর্মী কোনও গবেষণা হয়নি। এখনও এসব ক্ষেত্রে ভিকটিমের ওপর দোষ চাপানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।’
তরুণীদের ওপর এমন সহিংসতার প্রেক্ষাপটে দেখা দিয়েছে প্রতিবাদ ও বিতর্ক। ব্রিটিশ তরুণীদের একটি অংশ প্রতিবাদ হিসেবে ক্লাবগুলোকে সাময়িক বর্জন করার আহ্বান জানিয়েছে। তাদের কথা হলো, ক্লাবগুলোতে নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। প্রত্যেককে তল্লাশি করতে হবে। অন্যদিকে কিছু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, রাতে বাইরে বের হলে তরুণীরা যেনও শক্তপোক্ত পোশাক পরে।
এর প্রতিবাদে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে কয়েকজন তরুণী বলেছেন, ‘আমরা তো আর বর্ম পরে ঘুরে বেড়াতে পারবো না।’ আগে দেখা যেত পানীয়র মধ্যে চেতনানাশক দেওয়া হচ্ছে। তখন কাপ ঢেকে রাখার পরামর্শ দেওয়া হতো তাদের। এখন তো খাঁচায় ঢুকে চলাফেরা করা সম্ভব নয়।
অ্যালি ভ্যালেরো নামের ২০ বছর বয়সী এক তরুণী জানালেন, ক্লাব বর্জনের আহ্বান মানে এই নয় যে আমরা ঘরে বসে থাকতে বলছি। আমরা ক্লাব ম্যানেজারদের বলতে চাচ্ছি তারা যেনও তাদের পরিবেশটাকে আরও নিরাপদ করে।
এদিকে কিছু ইউনিভার্সিটির টুইট নিয়েও খেপেছেন ব্রিটিশ তরুণীরা। সম্প্রতি এক টুইটে ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, তরুণীরা যেনও ইনজেকশন ফোটানোর ঝুঁকিযুক্ত স্থানগুলো এড়িয়ে চলে। প্রতিবাদের তোপে সেই টুইট মুছে ফেলতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পুলিশ প্রধান সু ফিশ বললেন, ‘নারীরা অনেক দিন ধরেই এসব মেনে চলছেন। এখন সময় এসেছে পুরুষের আচরণ বদলানোর।’