শিরোনাম
স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় মিয়ানমারে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু এবারের সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির জান্তা বা সামরিক শাসকরা। বিশেষ করে, অন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সমর্থন নিয়ে সরকারের বিরোধিতা করা শান রাজ্যের তিনটি জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠীর একজোট হয়ে চালানো একের পর এক হামলায় ক্রমাগত নাস্তানাবুদ হচ্ছে সামরিক বাহিনী।
বিদ্রোহীদের কাছে এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং প্রতিবেশী দেশে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পালিয়ে আশ্রয় নেওয়ার খবর প্রায় প্রতিদিনই উঠে আসছে গণমাধ্যমে।
‘অপারেশন ১০২৭’
সামরিক জান্তার নতুন করে ক্ষমতা দখলের তিন বছর পূর্ণ হতে চলেছে। তবে প্রথম আড়াই বছর সামরিক বাহিনী দমন-পীড়নের মাধ্যমে যতটা সহজে ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিল, এখন সেই দৃশ্য অনেকটাই বদলে গেছে।
২০২১ সালের এপ্রিলে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেতৃত্বে নির্বাচনে জয়ী সদস্যরা জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করে, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় এনইউজি। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরাও এতে যোগ দেয়।
এরপর সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে মিলে তারা প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে এবং সব গোষ্ঠীর সমন্বয়ে তৈরি করে ‘পিপলস ডিফেন্স ফোর্স’।
সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সক্রিয় থাকলেও এটি নতুন মাত্রা পায় উত্তরাঞ্চলের তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী একজোট হয়ে আক্রমণ শুরুর পর।
২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর একজোট হয়ে হামলা চালায় দেশটির উত্তরের জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী, যাদের একসঙ্গে ডাকা হচ্ছে ‘থ্রি গ্রুপ অ্যালায়েন্স’ নামে। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) নিয়ে এই জোট গঠন করা হয়েছে। তারা এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন ১০২৭’।
এছাড়াও শত শত স্বেচ্ছাসেবী জাতিগত বিদ্রোহীদের সঙ্গে জান্তাবিরোধী লড়াইয়ে যোগ দিয়েছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে এই মুহূর্তে নানা ধরনের হামলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। আর তা কেবল একটি জায়গাতে নয়, বরং সারা দেশেই চলছে।
দখল হারাচ্ছে সামরিক বাহিনী
বিদ্রোহী গোষ্ঠীর হামলার মুখে চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহেও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পশ্চাদপসরণ অব্যাহত রয়েছে।
থিংক ট্যাংক ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি (আইএসপি) মিয়ানমারের তথ্য অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী এরই মধ্যে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে ৪৩ শতাংশেরও বেশি জায়গা হারিয়েছে।
থাইল্যান্ড-ভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম ইরাবতীতে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী এ পর্যন্ত ৩৩টি অঞ্চলের দখল হারিয়েছে। এর মধ্যে চিন, সাকাই, কিয়াং প্রদেশ এবং উত্তরাঞ্চলের শান এবং শিন রাজ্য উল্লেখযোগ্য। এসব এলাকা এখন নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যরা।
অক্টোবরে হামলা শুরুর পর থেকে হাজার হাজার সৈন্য তাদের সরঞ্জাম নিয়ে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সারা দেশে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ৪০০রও বেশি সীমান্ত চৌকি হারিয়েছে। এর মধ্যে সামরিক বাহিনীর আঞ্চলিক কার্যক্রম চালানোর অফিসও রয়েছে।
এদিকে, রাস্তায় অতর্কিত হামলা থামাতে ব্যর্থ সামরিক বাহিনী তাদের সীমিত সংখ্যক হেলিকপ্টারের ওপর নির্ভর করে ঘাঁটিগুলোতে রসদ পাঠাচ্ছে। তবে তাতেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না।
এই মাসে সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার এবং একটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কাচিন রাজ্যের বিদ্রোহীরা।
লড়তে চাইছে না সেনারা
গত নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের প্রেসিডেন্ট সতর্ক করে বলেছিলেন, দেশটির শান রাজ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধ সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পুরো দেশই ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের বিদ্রোহীদের উত্তর শান রাজ্যের বিশাল এলাকা দখলের কথা উল্লেখ করে একথা বলেন তিনি।
উল্লেখ্য, জোটের তিনটি জাতিগত সশস্ত্র বাহিনী এখন চীনের সঙ্গে সীমান্তের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এছাড়া, বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সম্প্রতি মিয়ানমারের চিন রাজ্যের পালেতোয়া অঞ্চলটি দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরত্বের এলাকাটি বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের সীমান্তের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে, বিদ্রোহীদের তোপের মুখে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর শত শত সদস্য সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা বেছে নিয়েছে। যুদ্ধ না করেই হাজার হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে।
এ সপ্তাহেও নতুন করে ২৭৮ জন মিয়ানমারের সেনা ভারতের মিজোরামে পালিয়ে গেছেন। নভেম্বর থেকে দফায় দফায় প্রায় ৬০০ জন সেনা সদস্য এভাবেই মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের অনেককে ফেরতও পাঠানো হয়েছে।
এর আগে, শান রাজ্যে পরাজিত ছয় জেনারেলকে তাদের অপহরণকারীদের সঙ্গে পানীয় পান করতে দেখা যায়। সেখানে তাদের মধ্যে অপমানবোধের চেয়ে স্বস্তিই বেশি দেখা যাচ্ছিল।
তবে সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার পরে তাদের মধ্যে তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অন্যদের হাল ছেড়ে দেওয়া থেকে বিরত রাখতেই এটি করা হয়েছিলে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযানের ৭৫ বছরের দীর্ঘ ইতিহাসে এমন পরিস্থিতি নজিরবিহীন। সেনা সদস্যদের মনোবল ভেঙে পড়েছে। এই অবস্থায় নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজও কঠিন হয়ে উঠেছে জান্তা সরকারের জন্য।