শিরোনাম
দক্ষিণ ইতালির মাতেরা শহরের একটি কফি শপে বসে বিবিসির সঙ্গে কথা বলছিলেন বাসিলিকাটা ট্যুরিজম বোর্ডের পরিচালক অ্যান্টনিও নিকোলেটি। তিনি একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও নগর পরিকল্পনাবিদ। কথা বলতে বলতে তিনি শৈশবে ডুব দেন। তাঁর চোখে ভেসে ওঠে শৈশবের অনুন্নত মাতেরা শহরের পথঘাট, জনপদ।
এখানেই অবস্থিত বহু শতাব্দীপ্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা সাসি, যেটিকে ইতিহাসে ‘গুহা শহর’ বা ‘গুহা বসতি’ বলা হয়। এটাই ইতালির প্রথম মানব বসতি। সাসি ভূগর্ভস্থ সভ্যতাটির বিকাশ ঘটেছিল খ্রিষ্টের জন্মের সাত হাজার বছর আগে। লাতিন সাসো শব্দ থেকে সাসি শব্দের উৎপত্তি, এর অর্থ পাহাড় বা বিশাল উঁচু পাথর।
নিকোলেটি স্মৃতিচারণ করছিলেন, যখন তিনি ছোট ছিলেন, তখন মাতেরায় কিছু পাকা সড়ক ছিল, যেগুলোতে অল্প কিছু গাড়ি চলত। পার্কিংয়ের পাশাপাশি ছিল কয়েকটি ফুলের বাগান। তাঁর বয়স যখন ১৭, তখন একদিন দেখলেন, একটি ফুলের বাগান ধসে পড়তে শুরু করেছে।
নিকোলেটি বলেন, দেখলাম শ্রমিকরা ভূগর্ভস্থ কিছু গুহা খুঁজে পেয়েছেন। তাঁরা বুঝতে চেষ্টা করছিলেন ফুলের বাগানটির নিচে আসলে কী আছে। ওই সময়টাতে নিকোলেটি তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতেন। সময়টা ভালোই কাটছিল।
তিনি বলেন, একদিন দেখলাম ডুবুরির সরঞ্জাম ও ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে এক ব্যক্তি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গে প্রবেশ করছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো সিনেমার দৃশ্য। পরে দেখা গেল, ফুল বাগানটির অবস্থান বিশাল এক পাথুরে চৌবাচ্চার ওপরে। বুঝতে পারলাম এটিই প্রাচীন ভূগর্ভস্থ শহর ‘সাসি’। এই সাসি প্রাচীন মাতেরার গুহা জেলা হিসেবে খ্যাত।
৮৫০ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত সাসির গুহা শহরে মানুষ বাস করত। সাসির আশপাশের এলাকাও পাহাড়ি ও পাথুরে ভূমি নিয়ে গঠিত। এসব স্থানেও আছে গুহার মতো বহুপ্রাচীন পাথুরে ঘর। ১৯৫০ সালে যখন সাসিতে উন্নয়নের জন্য উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়, তখনও দেখা যায় অন্তত ২০ হাজার মানুষ গুহা টাইপের ঘরগুলোতে বাস করছিল।
উচ্ছেদ অভিযানের পর বিশ্বজুড়ে হইচই শুরু হয়। রটে যায়– ‘গুহায় মানুষের বাস!’ আসলে সাসির আশপাশে যারা টিকে ছিল, তারা দারিদ্র্য ও নোংরা পরিবেশে বাস করত। অপরিষ্কার পানি পান করত। বিদ্যুতের আলো কিংবা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল না। এসব জানাজানি হলে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ তীর্যক মন্তব্য করতে থাকে। এতে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে ইতালির সরকার। এই পরিস্থিতিকে ‘জাতীয় অস্বস্তি’ বলে ঘোষণা করা হয়। যাহোক, পরে বাসিন্দাদের নতুন অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছিল।
প্রাচীনকালে সাসির ভূগর্ভস্থ সভ্যতার বিকাশ ঘটার সময় গুহা শহরটির জীবন টেকসই ও উন্নত ছিল। সভ্যতাটি আবিষ্কারের পর গবেষকরা বিস্ময়কর তথ্য পান। সাসির ভূগর্ভস্থ শহরে ছিল পাথুরে বাসস্থান। পানি ব্যবস্থাপনা খুবই উন্নত ছিল। শহরটি ছিল টেকসই জীবনযাপনের মডেল।
নগর পরিকল্পনাবিদ আন্টনি নিকোলেটি বলছেন, সাসির বাসিন্দারা সফল ও উন্নত সম্প্রদায় ছিল। সেখানে ছিল বৃষ্টির পানি সংগ্রহের উন্নত ব্যবস্থা। এমনকি ছিল চিত্তাকর্ষক ভূগর্ভস্থ ক্যানেলও। সভ্যতাটি নবম শতাব্দীতে সমৃদ্ধ ছিল। বাসিন্দাদের মধ্যে ছিল জমির মালিক, কারিগর ও বণিক। বুনন শিল্পে শক্তিশালী একটি সম্প্রদায় এখানে বাস করত। কৃষক-রাখালরা অনুর্বর, পাথুরে পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। গুহা ঘরগুলো শীত কিংবা গরম আবহাওয়ার উপযোগী ছিল। বসবাসের পাশাপাশি ঘরগুলো খাদ্য সংরক্ষণের জন্য আদর্শ ছিল। এগুলোতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
স্থপতি সাব্রিনা সেন্টনজে বলছেন, বাসিন্দারা পাথর কেটে যে জলাধার তৈরি করত, তাতে বুদ্ধিদীপ্ত নির্মাণশৈলী চোখে পড়ে। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও ফিল্টার করার ব্যবস্থা ছিল। বাসস্থানের ছাদে কৃষিকাজের নমুনাও মেলে।
সাসি সভ্যতায় ছিল ‘পানির ক্যাথেড্রাল’, যেগুলোকে ১৬ শতকের চৌবাচ্চাগুলোর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এসব চৌবাচ্চা ছিল ১৬ মিটার গভীর ও ৫০ মিটার প্রশস্ত। এগুলোতে সংরক্ষণ করা হতো মাটির পাহাড় থেকে আসা সতেজ খাবার পানি।
গবেষকদের তথ্যমতে, সাসির বাসিন্দারা বেশিরভাগই নিরামিষভোজী ছিলেন। প্রোটিনের উল্লেখযোগ্য উৎস ছিল শিম জাতীয় সবজি, যাকে বলা হতো লেগুমস। সাসির বাসিন্দারা ক্র্যাপিয়াটা (এক ধরনের খাবার) রান্না করত, এর উপাদান ছিল লেবুর মিশ্রণ।
নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞরা গুহা বসতিকে একটি টেকসই ‘স্মার্ট সিটি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো সাসিকে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ হিসেবে ঘোষণা করে। প্রাচীন ইতালিতে সাসিই ছিল সমৃদ্ধ জনপদ। বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে সভ্যতাটি খাপ খাইয়ে নিয়েছিল। এখন সাসি এলাকা অনেকটা বিলাসবহুল।