শিরোনাম
ছবির মতো সুন্দর দেশ। শহরগুলো গোছানো। পরিচ্ছন্ন সড়ক, রঙিন বাড়িঘর। সুদৃশ্য ভবনগুলো যেন অপরূপ প্রকৃতির কোলে ফুটে থাকা ফুল। গাছগাছালি, ঝরনা, নদী, পাহাড়-টিলা, স্বচ্ছ পানির জলাধার। পুরো দেশে লেকের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজারেরও বেশি। মানুষের নেই অভাব-অনুযোগ। খুনোখুনি তো দূরের কথা; চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারীর উৎপাত নেই বললেই চলে। উন্নত দেশে যা যা থাকে, সবই আছে ফিনল্যান্ডে। এ কারণে টানা ষষ্ঠবারের মতো এ বছরও তারা বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ।
জাতিসংঘের সুখী দেশের সূচক তৈরির বেশ কিছু মানদণ্ড রয়েছে। এর মধ্যে ওই দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা অন্যতম। এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাব্যবস্থা, নাগরিকদের মাথাপিছু আয়, দুর্নীতির পরিস্থিতি, সামাজিক সম্প্রীতি ও ব্যক্তিস্বাধীনতার মতো বিষয় আমলে নেওয়া হয়। এগুলোতে যেসব দেশ ভালো ফল করে, তালিকায় শীর্ষে তাদের ঠাঁই হয়।
বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় ফিনল্যান্ডের জীবনযাপনের মান খুবই উঁচু। সেখানে স্বাধীনতা, লিঙ্গসাম্য আছে। দুর্নীতি প্রায় নেই। অপরাধ এবং দূষণও কম। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক, ফিনল্যান্ডের বাসিন্দারা সেটা ছিন্ন করেননি। এ কারণে শহরের ভেতর দিয়ে যে নদীটি বয়ে গেছে, সেটির পানিও আয়নার মতো স্বচ্ছ!
বর্তমানে সবচেয়ে সুখী দেশটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন সানা মারিন। তিনি বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ সরকারপ্রধান। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি সুখী হওয়ার রহস্য প্রকাশ করেন। সানা মারিন জানান, তাঁর দেশ দৃঢ়ভাবে কল্যাণমুখী। শিক্ষাকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এ খাতে পর্যাপ্ত অর্থায়ন করা হয়। তিনি জানান, পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে তিনি ফিনল্যান্ডের উদার কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে চান। ঘটাতে চান ‘গ্রিন টেকনোলজি’র উন্নয়ন।
ইউরোপের শীতপ্রধান নরডিক অঞ্চলের দেশ ফিনল্যান্ড। জনসংখ্যা মাত্র ৫৫ লাখ।
এর মধ্যে রাজধানী হেলসিঙ্কিতে বাস করেন দুই লাখের বেশি মানুষ। এ শহরেই বেশিসংখ্যক অভিবাসীর বাস। তাদের সিংহভাগই সোমালি ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
বাল্টিক সাগরের উপকূলের দেশ ফিনল্যান্ডের প্রতিবেশী নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক। এ দেশগুলোকে স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশও বলা হয়। বলা হয়, উত্তর আমেরিকায় ইউরোপ থেকে প্রথম গিয়েছিল এ স্ক্যান্ডিনেভীয়রা। ৭৯৩ সাল থেকে ১০৬৬ সাল পর্যন্ত তারা পুরো ইউরোপে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়।
ফিনল্যান্ডের অর্থনীতির ভিত্তি বনজসম্পদ। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে যেখানে একটি দেশের ২৫ ভাগ এলাকায় বনভূমি থাকা দরকার, সেখানে ফিনল্যান্ডের ৭৪ শতাংশই বনভূমি। দেশের বনাঞ্চল শত শত প্রজাতির গাছপালা এবং লতাগুল্মে পূর্ণ। কাঠ ফিনল্যান্ডের অন্যতম প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ। দেশজুড়ে শত শত কারখানায় তৈরি হয় কাঠের নানা পণ্য। এগুলো বিদেশে রপ্তানি করা হয়। ফিনল্যান্ডের মোট রপ্তানি আয়ের ৪০ শতাংশ আসে এ রপ্তানি থেকে।
কল্যাণমুখী ফিনল্যান্ডে বেকার, অসুস্থ, অক্ষম ও বয়স্কদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই সার্বিক সহযোগিতা দেওয়া হয়। নাগরিকদের কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এছাড়া প্রতিটি পৌর এলাকায় আছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যার ব্যয় বহন করে রাষ্ট্রই। ফিনল্যান্ডে প্রতি এক হাজার মানুষের জন্য আছে ৬৯৩টি টেলিভিশন। সারাদেশে ৫৫টি দৈনিক পত্রিকা ও নিয়মিতভাবে অসংখ্য সাময়িকী প্রকাশ হয়। দেশের বাসিন্দারা বই পড়তে খুব ভালোবাসেন। দেশজুড়ে দেড় হাজারেরও বেশি লাইব্রেরি আছে।
ফিনল্যান্ডের বাসিন্দাদের বলা হয় ফিনিশ। তাদের ভাষার নামও ফিনিশ। তবে সুইডিশ ভাষাকেও গুরুত্ব দিয়ে শেখানো হয়। ফিনিশরা কফি ভালোবাসে। অন্য যে কোনো দেশের বাসিন্দাদের তুলনায় তারা বেশি কফি পান করে। চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে। জনসমাগমে খুব একটা কথা বলে না।
রাজধানী হেলসিঙ্কিতে থাকেন বাংলাদেশি তানভির অপু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি জানান, ফিনল্যান্ডকে সুখী দেশ কেন বলা হয়, ১৭ বছরে বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে তিনি এটা বুঝতে পেরেছেন। ফিনল্যান্ডের মতো নিরাপত্তা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা তিনি আর কোথাও পাননি।
রাশিয়ার সঙ্গে ফিনল্যান্ডের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। তারা পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হতে চায়। এজন্য ন্যাটোভুক্ত সব দেশের অনুমোদন প্রয়োজন। সম্প্রতি তারা তুরস্কের অনুমোদন পেয়েছে। তাই ন্যাটোর সদস্য হওয়া তাদের জন্য সময়ের ব্যাপার। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, ডয়চে ভেলে, লাইফ ইন নরওয়ে।