শিরোনাম
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে এক সপ্তাহ আগে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ ১৪ জন নিহত হন। সেই ধ্বংসস্তূপ থেকে রিসাইক্লিং প্ল্যান্টের জন্য কাজ করা কয়েকজন মধ্যবয়সী নারী বাছাই করছিলেন বিভিন্ন জিনিস। সেখান থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে শত শত রাশিয়ান বই। দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ইউক্রেনে রুশীকরণের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন জোরালো হচ্ছে। এটি রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের আরেকটি ব্যর্থতা।
খ্যাতিমান রুশ লেখক লিও তলস্তয়ের শৈশব, কৈশোর, যৌবন বইয়ের প্রচ্ছদ কফি কাপের মোড়ক কিংবা ডিমের কার্টন বানানো হচ্ছে অথবা ময়লা আবর্জনার ব্যাগে চলে যাচ্ছে। উপন্যাসের পৃষ্ঠাগুলো ইউক্রেনীয় ভাষায় অন্যান্য বইয়ের জন্য কাগজ হিসাবে বা সস্তা টয়লেট-পেপার হিসাবে আরেক স্থানে চলে যাচ্ছে। ঠিক এরপর মায়াকভস্কির কবিতার বই। তারপর সোভিয়েত পদার্থবিদ্যার পাঠ্যপুস্তক। পুশকিন ও দস্তয়ভস্কির জীবনী এরকম আরও অনেক কিছুই এভাবে মুছে ফেলা হচ্ছে।
২০১৪ সাল থেকে যখন রাশিয়া দনবাস ও ক্রিমিয়া দখল করে তখন থেকেই ইউক্রেনে রাশিয়ার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া বাষ্পীভূত হয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার বিনা প্ররোচনায় আগ্রাসন, তারপর ভয়াবহ আক্রমণ একে আরও কঠোরতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
ইউক্রেনে রুশীকরণ বিরোধী মনোভাব আরও জোরালো হচ্ছে, যেটি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয় এবং সরকারি নীতির বিপরীতে। রুশীরকরণ হলো অরুশ সম্প্রদায়ভুক্ত জনগণের ওপর জোর করে জার শাসকদের রুশ সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার বর্বর চেষ্টা। জার শাসকদের এই বলপূর্বক রুশ সংস্কৃতির প্রসারের চেষ্টাকে রুশীকরণ নীতি বলা হয়। লাখ লাখ ইউক্রেনীয় বৈষম্য ছাড়াই রাশিয়ান ভাষায় কথা বলে। কিন্তু দেশটির অনেক জায়গায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষ রাস্তার নাম পরিবর্তন করছে এখন। শুধু তাই নয় রাশিয়ান ও সোভিয়েত যুগের ভাস্কর্য টেনে নামানো হচ্ছে।
ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ত্রান্সকারপাথিয়ার রাজধানী উজহোরোদে, পতিত সোভিয়েত সেনাদের সমাধির পাথর থেকে লাল তারা সরানো হয়। বেশ কয়েকটি শহর থেকে আলেকজান্ডার পুশকিনের আবক্ষ মূর্তি অদৃশ্য হয়ে গেছে।
ইয়েকাতেরিনা আলেক্সেইভিনা, যিনি ক্যাথরিন দ্য গ্রেট নামে পরিচিত। ১৭৬২ সাল থেকে আমৃত্যু সমগ্র রাশিয়ার সম্রাজ্ঞী ছিলেন এবং তিনি দেশেটির দীর্ঘতম নারী শাসকও। ইউক্রেনের ওদেসা শহরে ক্যাথরিন দ্য গ্রেটের একটি বড় ভাস্কর্য, ডিসেম্বরের শেষের দিকে নামিয়ে বাক্সে রাখা হয়। শহরের চারুকলা যাদুঘরের বেসমেন্টে রাখা সেই ভাস্কর্যে এখন ধুলো জমছে।
কিয়েভের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি কিয়েভ মহিলা একাডেমী। গত ২৭ জানুয়ারি এই বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দেয় এটি রাশিয়ান ভাষায় কথা বলা নিষিদ্ধ করছে। যদিও সেটির প্রেসিডেন্ট পরে পিছিয়ে যান এবং বলেন এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হবে না।
রুশীকরণ নীতি বিরোধীতা শুরু হয়েছে ইউক্রেনের সাহিত্যেও। সাইয়েভো, কিয়েভের পৌরসভা পরিচালিত বইয়ের একটি দোকান, রুশ আক্রমণের শুরুতেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিন মাস পর যখন এটি আবার চালু হয়, তখন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও কিছু গ্রাহক রাশিয়ান ভাষায় সংগ্রহ করা বই পুনর্ব্যবহার করার জন্য কাজ শুরু করেন। এসব বই বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ একটি দাতব্য সংস্থাকে দান করেন তারা। সেই অর্থে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের জন্য পোশাক ও সরঞ্জাম কেনা হয়।
সেই দোকানের কর্মচারীদের একজন নাদিয়া কিবেনকো বলেন, ‘আমরা এমন একটি সংস্কৃতির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখতে চাই না যা আমাদের অবনমিত করতে চায়। যার একটি অংশ বিমান হামলার আশ্রয় নেয়। তার পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্ল্যান্ট টাওয়ারে হাজার হাজার বই জমা হয়েছে। তিনি বলেন, গতবছর জুলাই থেকে গ্রাহকরা ৬০ টন বই নিয়ে এসেছেন। লেনিনের ধুলোময় জীবনী থেকে শুরু করে রান্নার বই থেকে ম্যানুয়াল পর্যন্তও রয়েছে এতে। অন্যান্য বইয়ের দোকানও একই কর্মসূচি চালু করেছে।
ইউরি ডাইক নামে একজন অভিনেতা, আলেকজান্ডার অস্ত্রোভস্কির একটি নাটক ও নিকোলাই জাবোলতস্কির কবিতসহ একটি ছোট বই নিয়ে রিসাইক্লিং প্ল্যান্টের দিকে যান। তিনি বলেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি বহুবার অপব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু এখন আমাদের কাছে একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত আছে যখন আমরা আমাদের আসল ইতিহাসে ফিরে যেতে পারি, যেটি সোভিয়েত সরকার বা রাশিয়ান সাম্রাজ্য আমাদের ওপর চাপিয়েছিল তা নয়।’
রাশিয়া ১৭ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার আগ পর্যন্ত ইউক্রেনের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। ইউক্রেন ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অংশ ছিল। বারবার ইউক্রেনীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে দমন করা হয় সে সময়। ১৯ শতকের জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের অধীনে রুশীকরণ প্রকট আকার ধারণ করে। তিনি ইউক্রেনীয় ভাষায় শিক্ষাদান, বই প্রকাশ ও নাটক মঞ্চায়ন নিষিদ্ধ করেছিলেন।
রাশিয়ার আধুনিক জার, ভ্লাদিমির পুতিন, একটি পৃথক ইউক্রেনীয় সংস্কৃতির অস্তিত্ব অস্বীকার করছেন। পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের রুশ দখলদার বাহিনী এটিকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে। ইউক্রেনীয় নিউজ ওয়েবসাইট ব্লক করা হয়েছে। স্থানের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এমনকি বানানও পরিবর্তন হয়েছে।
বিধ্বস্ত শহর মারিউপোলে, ১৯৩০ সালে হলডোমার দুর্ভিক্ষে ভুক্তভোগী ও যুদ্ধে নিহতদের স্মৃতিচিহ্ন সরানো হয়। শহরের স্কুলগুলো এখন রাশিয়ান পাঠ্যক্রম অনুসরণ করতে বাধ্য হচ্ছে। কিয়েভের সরকারের সঙ্গে যোগসূত্রের সন্দেহে অগণিত ইউক্রেনীয়কে আটক করা হয়েছে এবং তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধও হয়েছেন অনেকে।
ফলাফলে, অন্তত ইউক্রেনের বাকি অংশে, পুতিনের মনে যা ছিল তা হয়নি। ২০২১ সালের গ্রীষ্মকালে, ৪১ শতাংশ ইউক্রেনীয় এ ধারণার সঙ্গে একমত হন যে ইউক্রেন ও রাশিয়া এক। গতবছরের বসন্তে, রাশিয়ার আগ্রাসনের পর সেই সংখ্যা নেমে হয় ৮ শতাংশ।
বেশিরভাগ ইউক্রেনীয় সোভিয়েত বা রাশিয়ান স্থানের নাম পরিবর্তনের ধারণাকে সমর্থন করে। এক বা দুই শতাব্দী আগে কবর দেওয়া রাশিয়ান লেখকদের আজকের যুদ্ধাপরাধের মূল্য দিতে হবে কিনা তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।
যুদ্ধের কারণে কষ্ট পাওয়া ইউক্রেনের অনেকের মতো একজন বলেন, তিনি এবং তার স্ত্রী, যিনি রাশিয়ায় বেড়ে উঠেছেন, রাশিয়ান কথা বলা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাকে আঘাত করে।’ তবে তিনি মনে করেন সাহিত্যের সীমাবদ্ধতা বন্ধ হওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, ‘এটি আমাকে মুসোলিনির কথা খুব বেশি মনে করিয়ে দেয়।’
ইউক্রেনের সবচেয়ে বেশি পরিচিত সমসাময়িক লেখক আন্দ্রে কুরেকভ। আন্দ্রে রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন এবং রাশিয়ান ভাষায় লেখেন। তিনি বলেন, ‘আমি আবেগ বুঝতে পারি। কিছু ইউক্রেনীয় বুদ্ধিজীবী তাদের নিজস্ব দেশপ্রেমিক পরিচয় বাড়ানোর জন্য রুশীকরণ নীতির বিরোধীতা করছেন। তিনি স্বীকার করেন, যুদ্ধের পর তার নিজের বই সম্ভবত রাশিয়ান ভাষায় প্রকাশিত হবে না।
তিনি আরও বলেন, ‘রাশিয়ান সবকিছুর প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত নেতিবাচক ও আক্রমণাত্মক। কিন্তু যদিও ইউক্রেনের কিছু অংশে রাশিয়ান ভাষার লেখকদের উপেক্ষা করা যেতে পারে। তবে অন্যদের যেখানে রাশিয়ার আধিপত্য রয়েছে, তাদের সরানো যাবে না।’
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট