শিরোনাম
যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের মেমফিস শহরে চলতি মাসের ১০ তারিখে পুলিশি নির্যাতনে মারা যান কৃষ্ণাঙ্গ যুবক টায়ার নিকোলস। নির্মম সেই নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশ করেছে মেমফিস নগর কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনায় স্থানীয় পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার পর সম্প্রতি ভিডিও ফুটেজগুলো প্রকাশ করা হয়।
ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, ২৯ বছর বয়সী নিকোলস মারা যাওয়ার পর ওই পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মাত্রার খুন, অসদাচরণ ও নিপীড়নের জোরালো অভিযোগ ওঠে। তার একদিন পরেই পুলিশ সদস্যদের শরীরে লাগানো ক্যামেরা ও রাস্তার পাশের খুঁটিতে লাগানো সিসি ক্যামেরা থেকে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে চার খণ্ডের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করা হয়।
অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা হলেন ডেমেট্রিয়াস হ্যালি, ডেসমন্ড মিলস জুনিয়র, এমিট মার্টিন, জাস্টিন স্মিথ ও ট্যাডারিয়াস বিন।
ভিডিও ফুটেজগুলোতে দেখা যায়, ৭ জানুয়ারি স্থানীয় একটি রাস্তায় নিকোলসের গাড়িটি থামান পুলিশ কর্মকর্তারা। পরে তাকে চালকের আসন থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। এ সময় নিকোলস চিৎকার করে বলেন, আমি কিছুই করিনি; শুধু বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছি।
পরে পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকার নির্দেশ দেন ও মুখে মরিচের গুড়া ছিটিয়ে দেন। এরপর কর্মকর্তারা চিৎকার করে নিকোলসকে উপুড় হয়ে থাকা অবস্থাতেই দুই হাত পিঠের ওপর জড়ো করতে বলেন। এ সময় এক পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, হাত দুটি আমি ভেঙে ফেলার আগেই এক জায়গায় করো।
এর কিছুক্ষণ পর নিকোলস মাটি থেকে উঠে দৌড় দেন। আর পেছন পেছন তাকে ধাওয়া করতে থাকেন ওই পুলিশ কর্মকর্তারা। এর মধ্যে একজন নিকোলসকে লক্ষ্য করে স্টান গান ফায়ার করেন। স্টান গানের বৈদ্যুতিক আঘাত পেয়ে নিকোলস আবারও মাটিতে পড়ে যান। পরে পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে ধরে বেধড়ক পেটান।
এ সময় নিকোলসকে চেপে ধরে রাখেন দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও আরেকজন সজোরে তাকে কয়েকবার লাথি মারেন। আরেক কর্মকর্তাকে লাঠিজাতীয় কিছু দিয়ে নিকোলসকে আঘাত করতে ও ঘুষি মারতে দেখা যায়।
নিকোলসকে এসময় মা, মা বলে চিৎকার করতে দেখা যায়, যা পুরো ঘটনার সবচেয়ে হৃদয় বিদারক অংশ বলে দাবি করছেন অনেকে। এর কিছুক্ষণ পরে ঘটনাস্থলে জরুরি স্বাস্থ্যসেবার কর্মীরা পৌঁছান। তারও প্রায় ১৯ মিনিট পর স্ট্রেচারে করে গুরুতর আহত নিকোলসকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তিনদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তিনি মারা যান।
এ ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে মেমফিসের সাধারণ জনগণ, যা ছড়িয়ে টেনেসি রাজ্যসহ পুরো যুক্তরাষ্ট্রে। তাই ভিডিও প্রকাশের আগে মেমফিসের পুলিশপ্রধান সেরেলিন ডেভিস ও নিকোলসের পরিবারের আইনজীবীরা বিক্ষোভ নিয়ে সতর্ক করার পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানান।
কিন্তু ভিডিওটি ফুটেজগুলো প্রকাশের পরপরই হাজার হাজার বিক্ষোভকারী মেমফিস শহরে জড়ো হন। এ সময় তারা ‘বিচার নেই, শান্তি নেই’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। তাছাড়া অনেক বিক্ষোভকারীর হাতে ‘পুলিশি সন্ত্রাস বন্ধ করো’ লেখা প্ল্যাকার্ড দেখা যায়। একপর্যায়ে তারা স্থানীয় একটি মহাসড়কে যানচলাচল বন্ধ করে দেন।
শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে নিকোলসের মা রোভন ওয়েলস বলেন, পুলিশের বর্বর নির্যাতনের শিকার হওয়ার সময় আমার ছেলে বাড়ি থেকে মাত্র ৮০ গজ মতো দূরে ছিল। যেভাবে আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি, এমন নির্মমভাবে আর কোনো মা যেন তার সন্তানকে না হারান। আমি যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, তা যেন কোনো মায়ের জীবনে না আসে।
নিকোলসের পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করা আইনজীবী বেন ক্রাম্প মেমফিস পুলিশ কর্তৃপক্ষকে তাদের স্করপিয়ন ইউনিট বিলুপ্ত ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছেন। সড়কে সহিংস অপরাধ নিয়ে কাজ করা পুলিশের এ স্কোয়াডের সদস্যরাই মর্মান্তিক ওই ঘটনায় জড়িত ছিলেন।
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, মেমফিসের ভিডিওটি দেখে আমি ক্ষুব্ধ ও গভীরভাবে শোকাহত। এরই মধ্যে এ ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। জঘন্য এ অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা অবশ্যই উপযুক্ত শাস্তির মুখোমুখি হবেন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় হোয়াইট হাউজ থেকে জানানো হয়, বাইডেন নিকোলসের মা ও সৎ বাবা রডনি ওয়েলসের সঙ্গে কথা বলেছেন। বিক্ষোভ সহিংস পর্যায়ে চলে গেলে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের বড় শহরগুলোর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো জানিয়েছে, তারা সম্ভাব্য বিক্ষোভ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এরই মধ্যে নিকোলসের মৃত্যুর বিষয়টি ‘ফেডারেল সিভিল রাইটস’ আইনের আওতায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ড।
যে পাঁচ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিকোলসকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে, তারা সবাই কৃষ্ণাঙ্গ। শনিবার (২১ জানুয়ারি) তাদের পুলিশ বিভাগ থেকে বরখাস্ত করা হয়। ৬ লাখ ২৮ হাজার বাসিন্দার শহরটির মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ।
ক্যালিফোর্নিয়ার সেক্রেমেন্টোতে বেড়ে ওঠা নিকোলস করোনা মহামারি শুরুর আগে মেমফিসে চলে আসেন। এখানে মা ও সৎবাবার সঙ্গে বসবাস ও ফেডএক্সে কাজ শুরু করেন তিনি। নিকোলসের চার বছর বয়সী এক সন্তান রয়েছে।
সূত্র: রয়টার্স