শিরোনাম
গুজরাটে ২০০২ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ২০২০ সালে দিল্লিতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ওপর বিবিসির দুই পর্বের একটি তথ্যচিত্র নিয়ে তোলপাড় চলছে ভারতে। ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদী কোয়েশ্চেন’ নামে ওই অনুসন্ধানী তথ্যচিত্রের প্রথম পর্বটি তৈরি হয়েছে গুজরাট দাঙ্গায় রাজ্যটির তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী এবং ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকা নিয়ে। আর বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইনকে কেন্দ্র করে দিল্লিতে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা নিয়ে তৈরি হয়েছে এর দ্বিতীয় পর্ব।
ভারতে যেন এই তথ্যচিত্রটি দেখা না যায় তা নিশ্চিত করতে বিজেপি সরকার যেভাবে নজিরবিহীন তৎপরতা শুরু করেছে, তাতে বিস্মিত অনেকেই। এ নিয়ে সারা বিশ্বে হইচই হচ্ছে। কিন্তু একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমের তথ্যচিত্র নিয়ে ভারতের মতো একটি বিশাল দেশের সরকারের মধ্যে এমন তীব্র স্পর্শকাতরতা কেন? এত উদ্বেগ ঠিক কীসের জন্য?
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা উড্রো উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান মনে করছেন, নরেন্দ্র মোদীর ভাবমূর্তির প্রশ্নে তার দল, অনুসারী ও সমর্থকদের অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে ভারতে।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, সন্দেহ নেই ভারতে নরেন্দ্র মোদী খুবই জনপ্রিয়। তার ভাবমূর্তি অনেকটা কাল্ট-এ (অতিমানবীয়) রূপ নিয়েছে। নেতার এই জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ থাকার বিষয়টি তার সমর্থকদের কাছে, সরকারের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
গুজরাট দাঙ্গায় মোদীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন নতুন কিছু নয়। বিবিসির তথ্যচিত্রে যা যা বলা হয়েছে তার বেশিরভাগই পুরোনো এবং ভারতীয়দের জানা।
তবে একটি বিষয় কিছুটা নতুন। তা হলো, দাঙ্গার পর সেটি নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের নিজস্ব একটি তদন্তের ফলাফলের কিছু অংশ প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে এসেছে বিবিসির তথ্যচিত্রে। ব্রিটিশ তদন্ত রিপোর্টটিতে গুজরাটে ‘জাতিগত হত্যাকাণ্ড’র মতো শব্দ ছিল। বলা হয়েছে, ওই হত্যাযজ্ঞের জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদী ‘সরাসরি দায়ী’ ছিলেন।
অবশ্য এমন সন্দেহ-অভিযোগও নতুন নয়। যদিও ২০১২ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ তদন্ত কমিটি দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ খারিজ করে দেয়। তারপরও বিতর্ক থামেনি।
‘বিশ্বনেতা হতে চান মোদী’
এসব বিতর্কে ভারতের রাজনীতিতে মোদীর কোনো ক্ষতি হয়েছে, তেমন কোনো প্রমাণ নেই। তাহলে এই তথ্যচিত্র ভারতের মানুষ দেখতে পেলেও কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো নরেন্দ্র মোদী বা তার দল বিজেপির?
বিরোধী অনেক দল, বিশেষ করে বামপন্থিরা ভারত সরকারের এই রাখ-ঢাক নিয়ে সোচ্চার হতে শুরু করেছে। তবে মাইকেল কুগেলম্যান মনে করেন না, বিবিসির এই তথ্যচিত্র অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মোদীকে আদৌ কোনো বিপদে ফেলবে।
তিনি বলেন, আমি মনে করি, তার বরং সুবিধা হতে পারে। তার (মোদী) সমর্থকরা দেখছে, বাইরে থেকে তাদের দেশের দুর্নাম করা হচ্ছে এবং প্রধানমন্ত্রী মোদী শক্তভাবে তার জবাব দিচ্ছেন। এসব দেখে তার সমর্থকরা খুশি হবে এবং তাতে জনপ্রিয়তা আরও বাড়তে পারে।
তারপরও বিবিসির তথ্যচিত্রটি নিয়ে বিজেপি সরকার যা করছে, তাতে অবাক হচ্ছেন অনেক পর্যবেক্ষক। কুগেলম্যানের কথায়, আমার মনে হয়, বিজেপি সরকার নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছে। যারা হয়তো এই তথ্যচিত্র নিয়ে আগে মাথাই ঘামাতো না, এত বাড়াবাড়ি দেখে এখন তারাও সেটি দেখার চেষ্টা করবে।
ভারত সরকারের এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে? কুগেলম্যান মনে করেন, বহির্বিশ্বে নিজের ভাবমূর্তি নিয়ে নরেন্দ্র মোদী খুবই উদ্বিগ্ন।
‘তিনি ভারতকে বিশ্বের দরবারে উঁচু জায়গায় বসাতে উদগ্রীব। ফলে, কীভাবে বাকি বিশ্ব তাকে দেখে তা নিয়ে মোদী উদ্বিগ্ন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই পর তিনি গুজরাট দাঙ্গার কারণে সৃষ্ট দুর্নাম ঘুচিয়ে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করছেন। এখানে নতুন যেকোনো হুমকি নিয়েই তিনি উদ্বিগ্ন।’
অবশ্য গুজরাট দাঙ্গার দুর্নাম ঘোচানোর চেষ্টায় মোদী যে অনেকটাই সফল হয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই। পশ্চিমা যেসব দেশ দাঙ্গার পর সবচেয়ে সরব ছিল, তারা কার্যত ওই পর্ব ভুলে গেছে। সেসব দেশের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছেন। এমনকি তার সময়ে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গেও ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, ভারতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের মর্যাদায় বসানোর চেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী নিজেও একজন শীর্ষ সারির বিশ্বনেতা হওয়ার চেষ্টা করছেন। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনি এই উচ্চাভিলাষের সুফলও পাচ্ছেন।
২০১৪ সালে ক্ষমতাগ্রহণের পর বারবার বিদেশ সফর করেছেন মোদী। আন্তর্জাতিক যেকোনো ফোরামে যোগ দেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করেন না তিনি। কুগেলম্যান বলেন, সন্দেহ নেই নরেন্দ্র মোদী চান বিশ্ব পরিসরে ভারতের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়ুক। কিন্তু সেই সঙ্গে নিজের মর্যাদা নিয়েও তিনি একইভাবে উদ্বিগ্ন। মোদী বিশ্বনেতা হতে চান।
‘তথ্যচিত্রের পেছনে মতলব’
কিন্তু এর মধ্যেই গুজরাট দাঙ্গার মতো স্পর্শকাতর ঘটনা নিয়ে আবার কথা শুরু হয়েছে। তাছাড়া এমন সময় বিবিসির এই তথ্যচিত্র প্রচার হলো যখন কয়েক বছর ধরে ভারতে সংখ্যালঘুদের অধিকার, গণমাধ্যমের অধিকারের প্রশ্নে বিজেপি সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে কম-বেশি সমালোচনা চলছে। বিশেষ করে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলো বারবার উদ্বেগ জানাচ্ছে।
দিল্লিভিত্তিক গবেষণা সংস্থা বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের শ্রীরাধা দত্ত মনে করেন, এসময় বিবিসির এই তথ্যচিত্র প্রচারের পেছনে শুধু সরকার নয়, ভারতের অনেক মানুষও মতলব দেখছে।
তিনি বলেন, বিশ্ব মানচিত্রে যখন ভারতের মর্যাদা দিন দিন বাড়ছে, তখন পুরোনো একটি বিতর্ক নতুন করে তোলা বহু মানুষ ভালো চোখে দেখছে না। তারা সন্দিহান। তারা ভাবছে, এর পেছনে অবশ্যই কোনো মতলব রয়েছে।
এ অবস্থায় গুজরাট দাঙ্গায় মোদীর ভূমিকা নিয়ে নতুন করে যে শোরগোল তৈরি হয়েছে, তা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার সম্ভাবনা খুবই কম। কার্যত, যে দুটি দেশ ২০০২ সালে দাঙ্গার পর মোদীর ওপর সবচেয়ে বেশি খড়গহস্ত ছিল, তারাও মোদীর পক্ষে নরম সুরে কথা বলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সরকার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা আর এই বিতর্কে মাথা ঘামাতে চায় না। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইসকে এক সংবাদ সম্মেলনে বিবিসির তথ্যচিত্র নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র অভিন্ন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অংশীদার।
গত সপ্তাহে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত এক এমপি ওই তথ্যচিত্রের কথা তুললে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেন, সেখানে নরেন্দ্র মোদীকে যেভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে, তার সঙ্গে তিনি একমত নন।
শ্রীরাধা দত্ত বলেন, এমনিতেই করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সবাই চাপের মধ্যে রয়েছে। এখন এই বিষয়টি কারোরই অগ্রাধিকারের মধ্যে নেই বলে আমি মনে করি।
আর কুগেলম্যানের মন্তব্য, অধিকাংশ দেশ অনেক আগেই গুজরাটের ঘটনা পেছনে ফেলে এগিয়ে গেছে।
তারপরও গুজরাট দাঙ্গা যে নরেন্দ্র মোদীর কাছে আজও কতটা স্পর্শকাতর বিষয়, বিবিসির এই তথ্যচিত্রের প্রচারের পর সেটি আরও একবার বোঝা গেলো।
সূত্র: বিবিসি বাংলা