জান্তা সরকারকে অস্ত্র তৈরিতে সহায়তা করছে ১৩ দেশের কোম্পানি

ফানাম নিউজ
  ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:৩৪

জাতিসংঘের সাবেক তিনজন বিশেষজ্ঞের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রসহ, ইউরোপ ও এশিয়ার ১৩টি দেশের বিভিন্ন কোম্পানি মানবাধিকার লঙ্ঘনে ব্যবহৃত অস্ত্র তৈরিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করছে। এ সহায়তার মধ্যে রয়েছে লাইসেন্স দেওয়া, কাঁচামাল সরবরাহ, সফ্টওয়্যার ও যন্ত্রাংশ সংযোজন ইত্যাদি।

সোমবার (১৬ জানুয়ারি) মিয়ানমারের বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদের (এসএসি-এম) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, ভারত, রাশিয়া, ইউক্রেন, সিঙ্গাপুর ও যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও পাঁচটি দেশের কোম্পানি মিয়ানমারে অস্ত্র উৎপাদন করতে সাহায্য করছে।

এসএসি-এম বলছে, কাপাসা নামে পরিচিত কারখানায় উৎপাদিত ও সামরিক বাহিনীর ডিরেক্টরেট অফ ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিজ (ডিডিআই) দ্বারা চালিত এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে বন্দুক, গোলাবারুদ ও ল্যান্ডমাইন। প্রাথমিকভাবে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা প্রতিরোধ দমনে এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা দখলের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিরোধীদের ওপর রক্তক্ষয়ী দমন অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। এমনকি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতি অস্থিরতা সত্ত্বেও বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র তৈরিতে অনেকাংশে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে তারা।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সাবেক বিশেষ প্রতিবেদক ইয়াংহি লি বলেন, কোনো রাষ্ট্র মিয়ানমারকে কখনো আক্রমণ করেনি আর মিয়ানমার অস্ত্র রপ্তানিও করে না। ১৯৫০ সাল থেকেই তারা নিজেদের জনগণের বিরুদ্ধে নিজেদের তৈরি অস্ত্র ব্যবহার করে আসছে।

তিনি আরও বলেন, বিদেশী কোম্পানি ও তাদের নিজ রাষ্ট্রের নৈতিক ও আইনী দায়িত্ব হলো, তাদের কোনো পণ্য যাতে মিয়ানমারের বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা।

একই সঙ্গে তাদের উচিত, মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন থেকে বিরত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা। এমনটি করতে ব্যর্থ হলে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বর অপরাধের সঙ্গে তারাও জড়িত বলা যায়।

এসএসি-এমের প্রতিবেদনটি মায়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাত্কারের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ফাঁস হওয়া বাজেট নথিসহ বিভিন্ন সূত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

সেখানে দেখা যায়, অস্ট্রিয়া, জার্মানি, জাপান, তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিগুলোর দ্বারা তৈরি উচ্চ ক্ষমতার অত্যাধুনিক যন্ত্র বর্তমানে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অস্ত্র কারখানায় ব্যবহৃত হচ্ছে।

এসব স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রগুলোতে অস্ত্র তৈরির সব ধরনের ফাংশন রয়েছে। যা অস্ত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে ব্যাপকভাবে সহায়তা করছে। আর যন্ত্রগুলো চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় সফ্টওয়্যারগুলো সরবরাহ করছে ফ্রান্স, ইসরায়েল ও জার্মানিভিত্তিক কোম্পানিগুলো।

এসব কোম্পানি মিয়ানমারে পণ্য বা যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য সিঙ্গাপুরকে ট্র্যানজিট হিসেবে ব্যবহার করে। তাছাড়া সিঙ্গাপুরের কোম্পানিগুলো মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও অন্যান্য দেশের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় রয়েছে।

এদিকে, এসব যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ বা মেরামতের দরকার হলে সেগুলো জাহাজে করে তাইওয়ানে পাঠানো হয়। সেখানে অস্ট্রিয়ান সরবরাহকারী জিএফএম স্টেয়ারের প্রযুক্তিবিদরা সেগুলো মেরামত করে আবার মিয়ানমারে পাঠিয়ে দেন।

অন্যদিকে, অস্ত্র উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানির মূল জায়গা হলো, চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘চায়না নর্থ ইন্ডাস্ট্রিজ গ্রুপ করপোরেশন লিমিটেড। তাছাড়া, শিপিং রেকর্ড বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অস্ত্র তৈরিতে প্রয়োজনীয় অপটিক্যাল সামগ্রী ও বৈদ্যুতিক ডেটোনেটরের মতো মূল উপাদানগুলো আসে ভারত ও রাশিয়া থেকে।

এসএসি-এমের আরেক সদস্য ক্রিস সিদোতি বলেন, কিছুদিন আগেই মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। সেখানকার একটি স্কুলে বোমা ও গোলাবর্ষণে বহু শিশুসহ সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন।

‘সেখানে আমরা যেসব বোমা ও গোলার খোলস পেয়েছি, সেগুলো ডিডিআইয়ের কারখানা থেকেই এসেছে বলে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এসব অস্ত্র তৈরির কিছু উপকরণ অস্ট্রিয়া থেকেও এসেছে বলে ধারণা করা হয়।’

বিশেষ উপদেষ্টা পরিষদ আরও জানায়, নিখুঁতভাবে লক্ষ্যস্থল র্নিধারণের যন্ত্রপাতিগুলো অস্ট্রিয়ার জিএফএম স্টেয়ার কোম্পানির তৈরি। বন্দুকের ব্যারেল তৈরিতে ব্যবহৃত এসব যন্ত্রাংশ একাধিক স্থানে পাওয়া গেছে।

কয়েক দশক ধরেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নানাবিধ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মধ্যে থাকলেও, তারা অস্ত্র তৈরি বন্ধ রাখেনি। উল্টো এ সময়ের মধ্যে তাদের অস্ত্র তৈরির কারখানার সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৮৮ সালে দেশটিতে ছয়টি অস্ত্রের কারখানা থাকলেও এখন তা প্রায় ২৫টিতে উন্নীত হয়েছে।

ক্রিস সিদোতির মতে, রাষ্ট্রগুলোকে অবশ্যই এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে তদন্ত করতে হবে ও প্রয়োজনে আইনী ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে আমরা যেসব কোম্পানিকে শনাক্ত করেছি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। তারা মিয়ানমারের জনদুর্ভোগকে লাভবান হওয়ার কাজে লাগিয়েছে। এজন্য বিদেশী কোম্পানিগুলিকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।