সামরিক প্রযুক্তির পালে নতুন হাওয়া

ফানাম নিউজ
  ১৫ ডিসেম্বর ২০২২, ০৬:১৪

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীকরণকে পাল্টে দিয়েছে। পাল্টে দিয়েছে বৈশ্বিক রাজনীতির প্রেক্ষাপট, হুমকির মুখে ফেলেছে বিশ্ব অর্থনীতি। তবে এ যুদ্ধের ফলে নতুন সব প্রযুক্তি তৈরির প্রবণতাও বেড়েছে। বিশেষ করে সামরিক প্রযুক্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে।

নতুন এসব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে এগিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ৩ ডিসেম্বর অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি বি-২১ রাইডার নামের বোমারু বিমান উন্মোচন করেছে দেশটি। এ বিমান পারমাণবিক পেলোড বহন করতে সক্ষম ও পাইলট ছাড়াই উড়তে সক্ষম।

বিমানটির নির্মাতা কোম্পানি নর্থরপ গ্রুমম্যানের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী তাদের কাছ থেকে কমপক্ষে ১০০টি বি-২১ বোমারু বিমান কেনার পরিকল্পনা করেছে।

অন্যদিকে, ৯ ডিসেম্বর যৌথ উদ্যোগে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান বানানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্য, ইতালি ও জাপান। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এরই মধ্যে এ যুদ্ধবিমান নির্মাণের প্রথম পর্ব উদ্বোধন করেছেন।

তিন দেশের যৌথ এ উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হলো, তীব্র গতি, উন্নত সেন্সর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয়ে এমন একটি যুদ্ধবিমান তৈরি করা, যাতে পাইলট যখন চরম চাপের মধ্যে থাকবে, তখন যাতে বিমানটি নিজে নিজেই কাজ করতে পারে।

প্রয়োজন হলে এ যুদ্ধবিমান পাইলটের ইনপুট ছাড়াই উড়ে যেতে পারবে। পাশাপাশি এটি হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপেরও সক্ষমতা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আবার আপনি যদি সম্প্রতি ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ওপর নির্মিত কোনো ভিডিও দেখেন, তবে আপনি নিজের অজান্তেই একটি অত্যাধুনিক সামরিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন বলে মনে হবে।

এ যুদ্ধ সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্টস এজেন্সির (ডার্পা) অত্যাধুনিক সব প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইন্টারনেট, লেজার, জিপিএস ও এমআরএনএ ভ্যাকসিনের মতো প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করছেন অনেকেই।

প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ যুদ্ধের ফলে যুদ্ধ ও প্রতিরক্ষায় কাজে লাগে এমন নতুন নতুন প্রযুক্তির উৎপাদন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। কারণ এ যুদ্ধ শুধু রাশিয়া-ইউক্রেনকে নয়, আত্মরক্ষা নিয়ে সচেতন যেকোনো দেশকে তার প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে প্ররোচিত করেছে।

ডার্পা প্রধান ড. স্টেফানি টম্পকিনস বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিমূর্ত সব বিষয়কে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে তার প্রতিরক্ষা ব্যয় ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। জার্মানি তার নিজস্ব বাজেট এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

নতুন এসব বাজেটের বেশিরভাগই ইউক্রেনকে দেওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের ক্ষয়ক্ষতি মেটাতে ব্যবহৃত হবে। অনেকে আবার এ অর্থ সামরিক গবেষণা ও উন্নয়নকাজে লাগানোর প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এ বাজেট দিয়ে নতুন সব বৈপ্লবিক প্রযুক্তি তৈরি করতে চান তারা।

ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য ডার্পা যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তা ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্র কেমন হতে পারে তার একটি আভাস দেয়। ডার্পা প্রধান ড. টম্পকিন্স বলেন, আমাদের মূল লক্ষ্য হলো যুদ্ধক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।

প্রত্যন্ত জায়গাগুলোয় সৈন্যদের কাছে পানি, খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি পরিবহন করার পাশাপাশি কোল্ড স্টোরেজ ও লজিস্টিকস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ডার্পা। এ কারণে তারা অত্যাধুনিক বায়োটেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রেই খাবার ও জ্বালানি থেকে শুরু করে ব্যথানাশক ওষুধ তৈরি করতে সক্ষম এমন প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে চায়।

ডার্পার এমন উদ্যোগ ও অন্যান্য সামরিক উদ্ভাবন বেসামরিক জীবনকে নতুন আকার দিতে পারে। যেমন বর্তমানে অনেক দেশই হাইপারসনিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে, যেগুলোর গতিবেগ শব্দের গতিবেগের চেয়ে ৫ থেকে ২৫ গুণ বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ভেনাস অ্যারোস্পেস হাইপারসনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উচ্চগতি সম্পন্ন অত্যাধুনিক বিমান তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের আশা, এ বিমান এক ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যাত্রীদের নামিয়ে দিতে পারবে।

একইভাবে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় দেশগুলো কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ শুরু করেছে। যেসব সমস্যার সমাধান বর্তমানে প্রচলিত অত্যাধুনিক কম্পিউটার দ্বারা সম্ভব নয়, কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রযুক্তির মাধ্যমে সেসব সমস্যা মুহূর্তের মধ্যে সমাধান করা যাবে।

ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) কোয়ান্টাম-ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টারের পরিচালক উইলিয়াম অলিভার বলেন, এখন পর্যন্ত কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রযুক্তি নিয়ে যেসব গবেষণা হয়েছে, সেগুলোতে অর্থায়ন করেছে বিভিন্ন দেশের প্রতিরক্ষা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

তিনি আরও বলেন, কম্পিউটারের বৈপ্লবিক এ ধরন কর্মক্ষেত্রে কতটা কার্যকর হতে পারে, তা এখনো নিরুপণ করা সম্ভব নয়। তবে ডার্পার ‘কোয়ান্টাম বেঞ্চমার্কিং’ প্রকল্পের মাধ্যমে বোঝা যেতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রযুক্তি কতটা সফল হবে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, স্নায়ুযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সামরিক গবেষণা ও উন্নয়নের যতটা প্রসার ঘটেছিল, সে তুলনায় সাম্প্রতিক সময়গুলোতে তেমন প্রসার দেখা যায়নি। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এক্ষেত্রে আবারও নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

ডার্পার সাবেক কর্মকর্তা ও বিনিয়োগকারী অ্যামি ক্রুস, যে কোনো দেশের জন্যই সামরিক বাজেটগুলো বেশ জটিল ও সমালোচনাপূর্ণ। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন যা শুরু করেছেন তাতে প্রযুক্তিখাতে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটতেও পারে।

সূত্র: ইকোনমিস্ট