শিরোনাম
আমাদের দেশের শিক্ষিত যুবসমাজের মধ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রচলন বেশ আগে থেকেই রয়েছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতে পড়তে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের মাঝে সব থেকে বেশি।
তবে বর্তমানে, অনেক শিক্ষার্থীই উচ্চশিক্ষার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেমন জার্মানি, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসকে বেছে নিচ্ছেন। তবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় জার্মানি হয়তো সবচেয়ে এগিয়ে।
নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা, সময়োপযোগী বিষয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্য মিলিয়ে শুধু বাংলাদেশ নয়; বিশ্বজুড়ে শিক্ষার্থীদের কাছে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য হয়ে উঠেছে জার্মানি।
তাছাড়া আরেকটি চমকপ্রদ খবর হলো, বুধবার (৩০ নভেম্বর) জার্মানির মন্ত্রিসভা প্রস্তাবিত অভিবাসন আইনের রূপরেখা উপস্থাপন করেছে। ২০২৩ সালের শুরুতেই আইনটি প্রণয়ন করতে চায় জার্মান সরকার। একই সঙ্গে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে বিদেশিদের জন্য আরও দ্রুত জার্মান নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ করে দিতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আজ আলোচনা করা যাক, উচ্চশিক্ষার জন্য কারা, কেন জার্মানিকে বেছে নেবেন। আর এ ক্ষেত্রে কী কী প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সবশেষে জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে।
যেসব কারণে উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানি উত্তম:
১. বিনামূল্যে শিক্ষা
জার্মানি মোট ১৬টি রাজ্য নিয়ে গঠিত। তার মধ্যে বাদেন-ইয়ুর্তেমবার্গ ছাড়া বাকি ১৫টি রাজ্যের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো টিউশন ফি নেই। এক্ষেত্রে পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আপনার কাছ থেকে ছয় মাস পরপর একবার শুধু সেমিস্টার ফি নেওয়া হবে। এই ফি বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে সচারচর ২৮০ থেকে ৩৫০ ইউরো, যা বাংলাদেশি টাকায় ২৪ থেকে ৩৪ হাজার টাকার মধ্যে হয়ে থাকে।
আরেকটি সুবিধার ব্যাপার হচ্ছে, সেমিস্টার টিকিটের মধ্যেই যাতায়াত খরচ অন্তর্ভূক্ত থাকায়, যেকোনো রাজ্যে গণপরিবহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া সেমিস্টার কার্ড দেখালেই চলবে। গণপরিবহনে যাতায়াত করতে আপনাকে আলাদা করে টিকিট কাটতে হবে না।
২. সহজ আবেদন প্রক্রিয়া
তৃতীয় পক্ষের সাহায্য ছাড়াই একজন শিক্ষার্থী নিজে নিজে ইন্টারনেটের সহায়তায় ভর্তি আবেদনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন। দেশটির কোন বিশ্ববিদ্যালয়, কোন কোর্স, কোন সেশনে ভর্তির আবেদনপত্র আহ্বান করছে, আবেদনের সময়সীমা ও যোগ্যতাগুলো কী কী, তা এ ওয়েবসাইট https://www.daad.de/de/ থেকে দেখতে পারেন।
৩. সহজ ভিসা প্রক্রিয়া
সাধারণত জার্মানির ভিসাপ্রাপ্তির প্রক্রিয়া ও ভিসা লাভের নিশ্চয়তা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে সহজ ও তুলনামূলক কম সময়সাপেক্ষ। ভিসার আবেদন ও এ সংক্রান্ত যেকোনো তথ্যের জন্য দেখতে https://dhaka.diplo.de/ ওয়েবসাইট ভিজিট করুন
৪. স্কলারশিপ
জার্মানিতে টিউশন ফি না থাকায় অন্যান্য দেশের তুলনায় স্কলারশিপ পাওয়ার হার কিছুটা কম। তবে নির্দিষ্ট কর্মক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে ডিএএডি বৃত্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন। আরও রয়েছে ইরাসমুস স্কলারশিপ।
এদিকে, জার্মানিতে যাওয়ার আগে বৃত্তি না পেলেও, ভালো ফলাফলের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মেয়াদি বৃত্তির ব্যবস্থা করা হয়। এসব বৃত্তি পাওয়ার জন্য নিয়মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে চোখ রাখতেই হবে।
৫. খণ্ডকালীন চাকরির সুবিধা
জার্মানিতে একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরি করতে পারেন। দেশটির নিয়মানুযায়ী, একজন শিক্ষার্থী বছরে ১২০ দিন পূর্ণ দিবস কিংবা ২৪০ দিন অর্ধদিবস কাজ করতে পারেন। এভাবে নিজের, এমনকি পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়াও সম্ভব।
খন্ডকালীন এসব কাজের মধ্যে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বারে কাজসহ ফুড ডেলিভারি উল্লেখযোগ্য। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রজেক্টে অধ্যাপকদের সঙ্গে কাজের যথেষ্ট সুযোগ পাওয়া যায়।
কোনো শিক্ষার্থী যদি শুরু থেকেই 'অড জব' না করে, অধ্যাপকের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হন ও সে অনুযায়ী এগিয়ে যান; তাহলে এ অভিজ্ঞতা দিয়েই দেশটির চাকরির বাজারে ভালো অবস্থান অর্জন করতে পারবেন।
৬. শেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে ভ্রমণের সুবিধা
যেসব শিক্ষার্থী ঘুরতে ভালোবাসেন, তারা উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিকেই এগিয়ে রাখেন। কারণ, একবার এদেশের স্টুডেন্ট ভিসা পেয়ে গেলে, আপনি শেনজেনভুক্ত ২৬টি দেশে ভ্রমণের ভিসা পেয়ে যাবেন। একপ্রকার পুরো ইউরোপ ঘুরে দেখার এ অভাবনীয় সুযোগ লুফে নেওয়ার জন্যই অনেকে জার্মানিতে পড়তে চান।
৭. পড়াশোনা শেষে চাকরি ও স্থায়ীভাবে থাকার সুবিধা
জার্মানিতে পড়ালেখা শেষ করার পর ১৮ মাসের একটি 'জব সার্চিং ভিসা' দেওয়া হয়। এ সময়ের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী তার সাবজেক্ট সংশ্লিষ্ট চাকরি খুঁজে নিতে পারলে জব সার্চিং ভিসাকে ওয়ার্কিং ভিসায় রূপান্তর করা হয়। দুই বছর চাকরি করার পর একজন শিক্ষার্থী পার্মানেন্ট রেসিডেন্স (পিআর) বা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করতে পারেন।
যাদের জন্য জার্মানি সর্বোত্তম
জার্মানিতে থাকা কিংবা পড়ালেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হলো ভাষা। স্বভাবগতভাবেই জার্মানরা নিজেদের ভাষাকে অনেক বেশি ভালোবাসেন। সাবলীল ইংরেজি জানলেও, সচারচর কেউ অনুরোধ না করলে তারা ইংরেজি বলেন না। তাই জার্মান ভাষা না জানলে দেশটিতে স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে শুরু চাকরির ক্ষেত্রে ভালোই ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
সুতরাং যতই সুবিধা দেওয়া হোক না কেন, জার্মান ভাষা শিখতে না পারলে কিংবা ভাষাটা কঠিন মনে হলে উচ্চশিক্ষার জন্য এ দেশে না যাওয়াটাই উত্তম।
বাংলাদেশে জার্মান ভাষা শেখার যাবতীয় তথ্য মিলবে https://www.goethe.de/de/index.html ওয়েবসাইটে। জার্মানিতে আসার আগে অন্তত 'এ টু' সমপর্যায়ের ভাষা শিখে আসলে ভালো হবে। না হলে পিআর পেতে বেশ কষ্টই হবে যাবে।
জার্মানিতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে কয়েকটি সাধারণ প্রশ্ন ও তার উত্তর:
১. জার্মানিতে ব্যাচেলর ডিগ্রির জন্য কী কী লাগবে?
উত্তর: ব্যাচেলর ডিগ্রির জন্য আপনাকে উচ্চমাধ্যমিকের (এইচএসসি) পরে জার্মানি স্বীকৃত বাংলাদেশের যেকোনো পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কমপক্ষে এক বছর পড়তে হবে ও টোটাল কোর্সের ২৫ শতাংশ শেষ করতে হবে।
গুগলে anabin university list bangladesh লিখে সার্চ করার পর যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে H++ থাকবে, সেগুলো জার্মান স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়। এ তালিকার যেকোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই হবে।
২. আইইএলটিএসে (IELTS) কতো পয়েন্ট কত লাগে?
উত্তর: আইইএলটিএসে মিনিমাম ৬ লাগবে। কিছুক্ষেত্রে ৫.৫ পয়েন্ট নিয়ে, এমনকি এমওআই দিয়েও অফারলেটার পাওয়া যায়। তবে সম্প্রতি জার্মান দূতাবাস রিকোয়ারমেন্ট হিসেবে মিনিমাম ৬ পয়েন্ট নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ, ভিসা পেতে আইইএলটিএসে ৬ থাকাটা বাধ্যতামূলক।
৩. সিজিপিএ কত লাগে?
উত্তর: ব্যাচেলরের সিজিপিএ ৩.৫ থাকাটা সবচেয়ে ভালো, তকে সমান ৩ থাকলেও চলবে। তবে এর থেকেও কম সিজিপিএ নিয়ে জার্মানিতে যাওয়ার নজির আছে। সুতরাং লেগে থাকলে সিজিপিএ একটু কম হলেও যেতে পারবেন।
৪. মাস্টার্সে আবেদন করতে কী কী কাগজপত্র লাগবে?
উত্তর: উচ্চমাধ্যমিক কিংবা ডিপ্লোমা সনদপত্র, উচ্চমাধ্যমিক কিংবা ডিপ্লোমার নম্বরপত্র, স্নাতক সনদ ও নম্বরপত্র, আইইএলটিএসে কমপকে্ষ ৬ পাওয়ার সনদ, পাসপোর্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষকের আলাদা আলাদা সুপারিশপত্র, ডিপার্টমেন্টর প্রধান অফিস সহকারীর সুপারিশপত্র, কাজের অভিজ্ঞতার সনদ, ইউরোপাস সিভি, লেটার অব মোটিভেশন, মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন (এমওআই), ট্রেড কোর্স সার্টিফিকেট (অটো ক্যাড অথবা এমএস অফিস)। সবগুলো ডকুমেন্ট নোটারি করতে হবে।
৫. কত টাকা লাগে?
উত্তর: মোটামুটি ১৩ লাখ টাকা লাগে। তার মধ্যে ব্লক অ্যাকাউন্টের সাড়ে ১০ লাখ, প্লেন ভাড়ার ৫০ হাজার ও অন্যান্য খরচ বাবাদ ২ লাখ টাকা কিংবা তার বেশি ধরতে হবে।
৬. ব্লক অ্যাকাউন্ট কী?
উত্তর: জার্মানিতে এক বছরের জন্য আপনার নিজের নামে ১০ হাজার ৫৩২ ইউরো জমা করতে হয়। যাওয়ার পরে আপনি পুরো টাকাটা ১২ কিস্তিতে ফেরত পাবেন।
অন্যান্য দেশের জন্য ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখাতে হয়, কিন্তু জার্মানিতে ব্যাংক স্টেটমেন্টের পরিবর্তে ব্লক অ্যাকাউন্ট করতে হয়। সোনালী, সিটি, ইস্টার্ন ব্যাংক ছাড়াও অন্যান্য ব্যাংকে ব্লক অ্যাকাউন্ট করাতে পারবেন।
৭. কখন আবেদন করবো?
উত্তর: আপনি বছরে উইন্টার (১৫ জানুয়ারি-১৫ জুলাই) ও সামার (১ অক্টোবর- ১৫ ডিসেম্বর) ২টা সেশনে আবেদন করতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে ডেডলাইন আলাদা হতে পারে তবে, জার্মানি উইন্টারে সবচেয়ে বেশি কোর্স অফার করে। জার্মানিতে। তাই উইন্টারে আবেদন করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।