শিরোনাম
মালয়েশিয়ার সাধারণ নির্বাচন শেষ হলেও সরকার গঠনে ব্যর্থ বড় দুই জোট পাকাতান হারাপান ও পেরিকাতান ন্যাশনাল। মালয়েশিয়ার রাজা আল-সুলতান আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, খুব শিগগির নিজের পছন্দসই ও যোগ্য ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন তিনি। সরকার গঠনে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় ব্যর্থ হওয়ার পরই এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছেন দেশটির রাজা।
মালয়েশিয়ার বার্তা সংস্থা বেরনামা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ব্যাপারে ন্যাশনাল প্যালেসের বাইরে উপস্থিত সাংবাদিকদের রাজা আব্দুল্লাহ বলেছেন, আমাকে দ্রুত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে দিন। আমার সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
গত ১৯ নভেম্বর মালয়েশিয়ার সংসদের নিম্নকক্ষ রাকিয়াতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি কোনো জোট বা দল। সংবিধান অনুযায়ী, সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী জোটের নেতা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। কিন্তু কোনো জোট একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন ও সরকার গঠনের বিষয়টি ঝুলে যায়।
এ বিষয়টি সমাধান করতে দেশটির সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া তিন প্রধান জোট আনোয়ার ইব্রাহিমের পাকাতান হারাপান কোয়ালিশন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিদ্দিন ইয়াসিনের পেরিকাতান ন্যাশনাল জোট ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল সাবরি ইয়াকোবের বারিসান ন্যাশনাল কোয়ালিশন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে।
কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনাল কোয়ালিশন সরকার গঠনে অন্য দুই জোটের একটিকেও সমর্থন দেবে না বলে জানিয়েছে। এরপরই ন্যাশনাল প্যালেসের পক্ষ থেকে খবর আসে, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজা নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেবেন।
দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, যদি রাজনৈতিক দলগুলো সরকার গঠনে ব্যর্থ হয় তখন রাজা এতে হস্তক্ষেপ করবেন। তবে রাজা আব্দুল্লাহ শেষ সুযোগ হিসেবে বুধবার সকাল ১০টায় বিএন-এর নির্বাচিত সংসদদের সঙ্গে রাজপ্রাসাদে বৈঠকে বসবেন।
মালয়েশিয়ার সংসদের মোট আসন সংখ্যা ২২২টি। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করতে হলে বিজয়ী দল বা জোটকে অন্তত ১১২টি আসনে জয়ী হতে হবে।
গত শনিবারের ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আনোয়ার ইব্রাহিমের পাকাতান হারাপান কোয়ালিশন ৮২টি, মুহিদ্দিন ইয়াসিনের পেরিকাতান ন্যাশনাল জোট ৭৩টি এবং ইসমাইল ইয়াকোবের বারিসান ন্যাশনাল কোয়ালিশন ৩০টি আসনে জয়ী হয়েছে। নির্বাচনে আনোয়ারের দল বেশি আসন পেলেও অন্য কোনো জোট তার সঙ্গে যোগ দিতে রাজি না হওয়ায় তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারছেন না।
একই সঙ্গে আনোয়ার ও মুহিদ্দিন উভয়েরই দাবি, সরকার গঠন করার মতো পর্যাপ্ত সমর্থন তাদের আছে। তবে কারা তাদের সমর্থন দিচ্ছেন সেটি খোলাসা করা হয়নি। মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল প্যালেসের পক্ষ থেকে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আনোয়ার ও মুহিদ্দিন দুজনকেই কথা বলার জন্য ডেকেছেন রাজা।
এদিকে সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলে জনগণের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি রোধে সতর্কবার্তা জানিয়েছে দেশটির পুলিশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের সাবধান করে কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায় নিয়ে ‘উসকানিমূলক’ পোস্ট করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
নির্বাচনের ফলাফলে জনগণের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হওয়ার পর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটি এখন ঝুলন্ত পার্লামেন্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি যেন না হয় সেজন্য এ সতর্কবার্তা জানাল পুলিশ।
আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপান কোয়ালিশন জোটটি একাধিক জাতি ও সংস্কৃতিকে ধারণকারী প্রগতিশীল জোট হিসেবে পরিচিত। অন্যটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের নেতৃত্বাধীন পেরিকাতান ন্যাশনাল জোট রক্ষণশীল মালয় মুসলিমদের জোট।
মালয়েশিয়াভিত্তিক সেন্টার ফর ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিজম পরিচালিত অনলাইনে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য পর্যবেক্ষণকারী একটি প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনের সময় এবং তার পর থেকে দেশটির সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর রাজনৈতিক আলোচনায় জাতিভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাখ্যান বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে।
শনিবারের নির্বাচনে শরিয়া আইন প্রবর্তনের পক্ষে থাকা একটি ইসলামিক দলের উত্থানে দেশটির বিভিন্ন নীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে অনেক বিনিয়োগকারীর মধ্যে অস্বস্তি কাজ করছে। বহু জাতির মালয়েশিয়ায় জাতি ও ধর্ম সবসময়ই সংবেদনশীল ইস্যু। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলিম এবং জাতিগতভাবে মালয় হলেও সেখানে ভিন্ন ধর্ম বিশ্বাসী জাতিগত চীনা ও ভারতীয়র সংখ্যাও কম নয়।
পুলিশ বলছে, নির্বাচনের পর তারা জাতিগত ও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং রাজতন্ত্রকে অপমান করে দেওয়া সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট শনাক্ত করছে।
‘জননিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার জন্য হুমকি হতে পারে এমন পরিস্থিতি উসকে দেওয়ার চেষ্টা করা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে’- গতকাল সোমবার এক বিবৃতিতে এমনটাই বলেছেন দেশটির পুলিশের মহাপরিদর্শক এক্রিল সানি আবদুল্লাহ সানি।
তবে আরোয়ার বা মুহিউদ্দিন কারও পক্ষেই সহজে অন্য রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন সম্ভব হবে না বলে অনেকের ধারণা। কারণ, মুহিউদ্দিনের জোটে পিএএস নামের একটি ইসলামী দল রয়েছে, যারা মালয়েশিয়ায় কঠোর শরিয়া আইন প্রবর্তনের জন্য প্রচার চালিয়ে আসছে। অন্যদিকে আনোয়ারের জোটে আছে প্রধানত জাতিগতভাবে চীনাদের সমর্থিত দল ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টি, যে দলটি রক্ষণশীল বহু মালয় ভোটারের কাছে চরম অপছন্দের।
মালয়েশিয়ার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা বলছেন, নির্বাচনের পর থেকে ভিডিও শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম টিকটকে ১৯৬৯ সালের ১৩ মে কুয়ালালামপুরে হওয়া প্রাণঘাতী দাঙ্গার উল্লেখ করা অনেক পোস্ট তাদের নজরে পড়েছে। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় আগের ওই সংঘর্ষে প্রায় দুইশো মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল।
ওই বছরের ১০ মে সাধারণ নির্বাচনে জাতিগতভাবে চীনা সম্প্রদায় সমর্থিত রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতায় আসার পথ তৈরি হওয়ার পরই ভয়াবহ সেই দাঙ্গা দেখা যায়।