শিরোনাম
যুক্তরাজ্যই একমাত্র দেশ নয়, যারা গত সপ্তাহে নতুন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইতালির প্রথম কট্টর ডানপন্থি সরকারপ্রধান হিসেবে গত ২২ অক্টোবর শপথ নিয়েছেন জর্জিয়া মেলোনি। সাধারণ নির্বাচনে তার দল ‘ব্রাদার্স অব ইতালি’ অন্যদের চেয়ে বেশি আসন জেতার পর নতুন সরকার গঠনে দেরি করেননি তিনি। ভোটের এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে কুইরিনাল প্রাসাদে প্রবেশ করেন মেলোনি।
তিনি খুব দক্ষতার সঙ্গে একটি জোট সরকার গঠন করেছেন, যা দেখে মনে হচ্ছে প্রথাগত ইতালীয় সরকারের তুলনায় এটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, আজকালকার ব্রিটিশ সরকারের তুলনায় তো বটেই। মেলোনির এই জয়ে অবশ্য উদারপন্থিরা খুশি নন। গর্ভপাত ও সমকামী ইউনিয়নের প্রতি তার দলের বিরোধিতা এবং অভিবাসনের বিষয়ে অপ্রীতিকর মনোভাবের কারণে অনেকেই পিছু হটছেন। যদিও তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তারা কিছুটা হলেও সান্ত্বনা পেতে পারেন।
ইউক্রেন ইস্যুতে মেলোনির অবস্থান কঠিন বলেই মনে হচ্ছে। তিনি ভ্লাদিমির পুতিনকে মূল্যবোধের রক্ষক নয়, বরং শিকারী হিসেবে দেখেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পার্লামেন্টে নিজের প্রথম বক্তৃতায় ইউক্রেনের প্রতি ইতালির সমর্থন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন কট্টর ডানপন্থি এ নেতা। বলেছেন, কেবল একটি সার্বভৌম দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতার লঙ্ঘন আমরা মেনে নিতে পারি না বলেই নয়, এটি আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষারও সর্বোত্তম উপায়।
এটা ঠিক যে, তার জোটের অংশীদার নর্দান লীগের মাত্তিও সালভিনি এবং ফোরজা ইতালিয়ার সিলভিও বার্লুসকোনির সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তবে জোটের মধ্যে মেলোনির দল এতটাই প্রভাবশালী যে, ইউক্রেন ইস্যুতে তার অবস্থান বদলানো জোটসঙ্গীদের জন্য কঠিন হবে।
এছাড়া, পূর্বসূরী মারিও দ্রাঘিকেও ধন্যবাদ দিতে পারেন ইতালির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। দ্রাঘির শাসনামলে জ্বালানি সরবরাহের উৎস বৈচিত্র্যময় করার ক্ষেত্রে ভালো কাজ করেছে ইতালি। যদি এ বছর বা আগামী বছরগুলোতে প্রবল শীত আসে এবং ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন ত্যাগ করাতে ইউরোপকে ঠান্ডায় জমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন পুতিন, তবে ইতালির খুব একটা সমস্যা হবে বলে মনে হচ্ছে না।
অনেকেই জর্জিয়া মেলোনিকে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানের নারী সংস্করণ হিসেবে দেখেন। সরকারের দুর্নীতি ও স্বৈরাচারী প্রবণতা নিয়ে অরবানের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবাদ নতুন নয়। তবে মেলোনি ব্রাসেলসের সঙ্গে লড়াইয়ে নামবেন, এমন সম্ভাবনা কম।
জর্জিয়া মেলোনি তার সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাবেক প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও তাজানিকে। তিনি সম্ভবত দ্রাঘি ও ইইউ’র অর্থনৈতিক সংস্কার পরিকল্পনার সঙ্গেই থাকবেন। হতে পারে এতে কিছুটা পরিবর্তন আসবে, তবে তা আহামরি বড় কিছু হবে বলে মনে হয় না। ওই পরিকল্পনা অনুসারে, সংস্কার অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় ২০ হাজার কোটি ইউরো অর্থসহায়তা দেবে ইইউ।
ইতালির নতুন সরকারের অর্থমন্ত্রী নিয়োগের আগে বেশ যাচাইবাছাই হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এ পদে একজন প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় ব্যাংকার টাইপ কাউকে চেয়েছিলেন মেলোনি। কিন্তু তা পাননি। এটি হতাশাজনক। তবে ফলাফল এখনো যুক্তিসঙ্গত। ইতালির নতুন অর্থমন্ত্রী হয়েছেন জিয়ানকার্লো জিওরগেত্তি। তিনি সালভিনির দলের উপ-প্রধান। যদিও নর্দান লীগকে এখনো ইউরোসেপ্টিক (ইইউর প্রভাব বৃদ্ধির বিরোধী) হিসেবে দেখা হয়। তবে জিওরগেত্তি এসেছেন দলের ব্যবসাপন্থি উইং থেকে। প্রকৃতপক্ষে, অর্থমন্ত্রী হিসেবে জিওরগেত্তির নিয়োগ হতে পারে সালভিনির প্রভাব সীমিত করার একটি উপায়।
তাই এখন পর্যন্ত স্বস্তির আভাস মিললেও ভবিষ্যতের কোনো নিশ্চয়তা নেই। ধরে ধীরে মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে গোটা ইউরো জোন। এতে ইইউ’র যেকোনো সদস্যের চেয়ে শঙ্কা বেশি ইতালির। অনেক পর্যবেক্ষকের আশঙ্কা, মারিও দ্রাঘি যে সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছিলেন, এখন তার গতি কমে যাবে অথবা এটি ক্ষমতার কেন্দ্রীয়করণ বা সুরক্ষাবাদে পরিণত হবে।
ইতালির ঘাড়ে এরই মধ্যে ২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ইউরো ঋণের বোঝা রয়েছে, যা দেশটির জিডিপির প্রায় ১৫০ শতাংশ। সুদের হার আরও বাড়লে এটি অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে।
তাছাড়া, ইতালির নতুন প্রধানমন্ত্রীর অভিজ্ঞতাও কম। ৪৫ বছর বয়সী মেলোনি যুবমন্ত্রী হিসেবে মাত্র তিন বছর দায়িত্বপালন করেছেন, তা-ও আবার এক দশক আগে। তার দল ব্রাদার্স অব ইতালি ২০১৮ সালের নির্বাচনে মাত্র চার শতাংশ ভোট পেয়েছিল।
জর্জিয়া মেলোনির বর্তমান সাফল্যের পেছনে অন্য দলগুলোর ব্যর্থতার অবদানই বেশি। এর আগে প্রত্যেক দলই ভোটারদের হতাশ করেছে। ফলে মেলোনি আসন্ন ঝড় কীভাবে সামলাবেন, তা নিয়ে ইতালীয়দের পাশাপাশি অন্য ইউরোপীয়দেরও একইভাবে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট