শিরোনাম
২০২০ সালের আগস্ট মাস। গভীর রাতে বেজে ওঠে খ্যাতনামা ব্রিটিশ আইনজীবী ফিওনা শ্যাকলেটনের ফোন। ফোনটি করেছিলেন যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী চেরি ব্লেয়ার। ফোনে চেরি চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য দেন। তিনি জানান, শ্যাকলেটন ও তাঁর এক মক্কেলের ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে।
সে সময় ফিওনা শ্যাকলেটনের মক্কেল ছিলেন জর্ডানের রাজকুমারী হায়া বিনতে আল-হুসাইন। রাজকুমারীর হয়ে তাঁর সাবেক স্বামী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাকতুমের বিরুদ্ধে এক মোকদ্দমায় লড়ছিলেন তিনি। দুবাইয়ের এই শাসকই ফোনে আড়ি পাতছিলেন বলে চেরি ও শ্যাকলেটনের সন্দেহ হয়। আর এই আড়ি পাতা হয়েছিল সম্প্রতি সাড়া ফেলা ইসরায়েলি হ্যাকিং সফটওয়্যার পেগাসাসের মাধ্যমে।
আড়ি পাতার এ ঘটনা বিস্তারিত উঠে এসেছে লন্ডনের হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে। সেখানে এ জন্য দায়ী করা হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাকতুমকে। শ্যাকলেটন ও তাঁর রাজপরিবারের মক্কেলের ফোনে কীভাবে আড়ি পাতা হয়েছিল, তা উঠে এসেছে আদালতের শতাধিক পাতার নথিতে। জানান হয়েছে গোপনীয়তার চাদরে মোড়া এ ঘটনার আদ্যোপান্ত।
শুরুটা যেভাবে
পেগাসাসের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনএসওর একজন উপদেষ্টা হিসেবে গত বছর কাজ করছিলেন চেরি ব্লেয়ার। আদালতের নথিতে প্রকাশ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সে বছরের ৫ আগস্ট শ্যাকলেটনকে একটি ই–মেইল পাঠান তিনি। ই–মেইলে তিনি এই আইনজীবীকে বলেন, ‘রাতে আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। যত রাতই হোক কথা বলাটা গুরুত্বপূর্ণ’। চেরি ব্লেয়ারকে ভীষণ উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল বলে আদালতকে জানিয়েছিলেন শ্যাকলেটন।
শ্যাকলেটনের সঙ্গে কথা বলা নিয়ে কেন এতটা তাড়াহুড়া করছিলেন—আদালতে তার জবাব দিয়েছিলেন চেরি ব্লেয়ার। এনএসওর একজন জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন বলে উল্লেখ করেন তিনি। ওই কর্মকর্তা চেরিকে জানান, শ্যাকলেটন ও তাঁর মক্কেলের ওপর পেগাসাসের মাধ্যমে আড়ি পাতা হচ্ছে। এনএসওর দাবি, শুধু অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের ওপর নজরদারি করতেই বিভিন্ন দেশের কাছে এই হ্যাকিং সফটওয়্যারটি সরবরাহ করা হয়েছে। ফলে ওই দুজনের ওপর আড়ি পাতার বিষয়টিকে অনৈতিক বলে মনে করছিলেন এনএসওর কর্মকর্তা। এসবের জের ধরে চেরিকে শ্যাকলেটনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছিল।
আদালতকে দেওয়া চেরির স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, এনএসও তাঁর সঙ্গে এ বিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করেছে। তবে শ্যাকলেটন ও জর্ডানের রাজকুমারীর ফোনে আড়ি পাতার পেছনে কলকাঠি কে নাড়ছেন, তা জানানো হয়নি। এনএসও তাঁকে শুধু এটুকুই আশ্বস্ত করেছিল যে দুজনের ফোনে যে আর অনুপ্রবেশের ঘটনা না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
শ্যাকলেটনের সঙ্গে ফোনালাপের পরদিনই চেরি তাঁর সঙ্গে আবার কথা বলেন। এ সময় তিনি যে এনএসওর হয়ে কাজ করছেন, তা শ্যাকলেটনকে জানান। পরে আবার ১১ আগস্ট দুজনের কথা হয়। সবকিছু মিলিয়ে তাঁদের সন্দেহ হয়, আড়ি পাতার পেছনে হাত রয়েছে দুবাইয়ের শাসকের।
কেন চেরির সন্দেহের তীর দুবাইয়ের দিকে গেল তার জবাবও আদালতকে দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘রাজকুমারী হায়া ও শ্যাকলেটনের ওপর আর কারও আগ্রহ থাকার কারণ নেই বলে আমার মনে হয়েছিল। এনএসওর কর্মকর্তার সঙ্গে কথোপকথনে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আড়ি পাতার সঙ্গে জড়িত পক্ষ ছোট নাকি বড় কোনো দেশ? এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা ছোট দেশের কথা উল্লেখ করেন। সেখান থেকেই দুবাইয়ের কথা আমার মাথায় আসে।’
এদিকে আদালতে এসব নিয়ে কথা বললেও রয়টার্সের কাছে এ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেননি চেরি ব্লেয়ার ও শ্যাকটন। আর গত বুধবার মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাকতুম নিজের বিরুদ্ধে যাওয়া লন্ডনের আদালতের রায় একেবারেই উড়িয়ে দিয়েছেন। আদালতের ওই রায়কে অনৈতিক আখ্যায়িত করে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ আমি নাকচ করে এসেছি। আগামীতেও তা করে যাব।’
চেরির সন্দেহ থেকেই শুধু উঠে আসেনি মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাকতুমের নাম। গত বছরে একই সময়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের এক অধিকারকর্মী ওপর পেগাসাসের নজরদারি নিয়ে কাজ করছিলেন বিল মার্কজেক নামের একজন ব্যক্তি। তিনি কানাডার ইন্টারনেট নিরাপত্তাসংক্রান্ত একটি নজরদারি প্রতিষ্ঠানের গবেষক।
মার্কজেকের গবেষণায় উঠে আসে, গত বছরের ৪ আগস্ট পেগাসাসের মাধ্যমে শ্যাকলেটনের আইনি প্রতিষ্ঠান পেইন হিকস বিচে (পিএইচবি) হামলা চালানো হয়। বিষয়টি তিনি লন্ডনে তাঁর পরিচিত আইনজীবী মার্টিন ডে-কে জানান। তখনই পিএইচবিকে পেগাসাসের মাধ্যমে হামলার খবরটি ই–মেইল করেন মার্টিন ডে।
এ নিয়ে পরে পিএইচবির বিরোধ নিষ্পত্তিসংক্রান্ত বিভাগের প্রধান ডোমিনিক ক্রসলে কথা বলেন গবেষক মার্কজেকের সঙ্গে। তাঁদের আলাপচারিতার একটি হাতে লেখা নোট আমলে নিয়েছে লন্ডনের হাইকোর্ট। ওই নোটে ক্রসলে লেখেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে হামলাটি ইউএই সরকার চালিয়েছে। তবে নিশ্চিত করে বলা কঠিন।’
ব্রিটিশ আদালতের নথিতে উল্লেখ করা হয়, আগস্টের ৭ তারিখে ক্রসলেকে একটি ই–মেইল করেন মার্কজেক। সেখানে তিনি জর্ডানের রাজকুমারী ইস্যুতে যে কয়জনের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে, তাঁদের একটি তালিকা তুলে ধরেন। তালিকায় নাম আসে রাজকুমারী হায়া, তাঁর আইনজীবী শ্যাকলেটন ও নিক ম্যানারস এবং তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সদস্যদের।
ই–মেইলে মার্কজেক জানান, পেগাসাসের মাধ্যমে হায়ার ফোন থেকে ২৬৫ মেগাবাইট তথ্য হাতিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে ফোন থেকে আদতে কী তথ্য নেওয়া হয়েছিল, তা জানা যায়নি।
‘প্রতিহিংসার জেরেই ঘটেছে সবকিছু’
ব্রিটিশ আদালতকে রাজকুমারী হায়ার আইনজীবী চার্লস গিকি বলেন, ‘ইউএইতে শ্যাকলেটন ও হায়াকে এখন শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে। চেরি ব্লেয়ার মনে করছেন, রাজকুমারীর প্রতি প্রতিহিংসা থেকেই আড়ি পাতার ঘটনা ঘটেছে। ইউএই তাদের সফটওয়্যারের লাইসেন্সের সীমা লঙ্ঘন করেছে।’
চার্লস গিকির ভাষ্য, গত বছরের আগস্টে আইনজীবী শ্যাকলেটনে চেরি ব্লেয়ার বলেন, আরব আমিরাত যদি প্রকৃত সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করতে পেগাসাসের ব্যবহার না করে, তাহলে তাদের কোনো ঝামেলা আছে। সে সময় চেরি জানান, এনএসও পেগাসাস নিয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে চায় না।
এদিকে শ্যাকলেটন ও হায়ার ফোনে আড়ি পাতার পর গত আগস্ট ঘটনা তদন্তে নামে পেগাসাসের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনএসও। হ্যাকিং সফটওয়্যারটি সন্দেহভাজন ওই ব্যবহারকারীর সঙ্গে দেখাও করেন এনএসও কর্মীরা। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে লন্ডন হাইকোর্টকে একটি চিঠি পাঠায় তারা।
চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, ১৫ সেপ্টেম্বরের দিকে তদন্ত শেষ করেছে তারা। আলোচিত এই আড়ি পাতার ঘটনায় আদতে কী ঘটেছিল, তার জবাব অবশ্য তদন্তে মেলেনি। তদন্ত শেষে এনএসও সিদ্ধান্ত নেয় হ্যাকিংয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পক্ষের সঙ্গে চুক্তি শেষ করবে তারা। এর জের ধরে ৭ ডিসেম্বর চুক্তি রদ করা হয় বলে জানায় প্রতিষ্ঠানটি।
আদালতকে আইনজীবী চার্লস গিকি বলেন, সবকিছুর মধ্য রাজকুমারী ও তাঁর আইনজীবীর ফোনে আড়ি পাতার ঘটনায় একজনেরই সংশ্লিষ্টতা মিলছে। আর তিনি হলেন শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল-মাকতুম। সূত্র: প্রথম আলো