শিরোনাম
১৯৮৮ সালে ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ লিখে বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় তুলেছিলেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক সালমান রুশদি। মুসলমান দেশগুলো বিশেষ করে ইরান তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনে। দেশটির তৎকালীন সর্বোচ্চ নেতা খোমেনি রুশদির মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া দেন। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারীকে ৩০ লাখ ডলার পুরস্কারের ঘোষণাও দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত ৩৩ বছর পর একজন উগ্রপন্থি রুশদিকে আক্রমণ করতে সক্ষম হলো। এতে স্তব্ধ বিশ্বের লেখক সমাজ।
সালমান রুশদির ওপর আক্রমণকে সেই আশির দশক থেকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হিসেবে দেখে আসছে পশ্চিমা বিশ্ব। রুশদির ওপর আক্রমণে তাই আতঙ্কিত বোধ করছেন মুক্তচিন্তক থেকে শুরু করে লেখক-বুদ্ধিজীবীরা। লিখেছেন তৃষা বড়ুয়া
রুশদির বিতর্কিত উপন্যাস
সালমান রুশদি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন ব্রিটিশ-আমেরিকান ঔপন্যাসিক। ব্রিটিশদের মধ্যে অন্যতম খ্যাতনামা ও সফল লেখক তিনি। তার দ্বিতীয় উপন্যাস মিডনাইট’স চিলড্রেন ১৯৮১ সালে সম্মানজনক বুকার পুরস্কার পায়। তুখোড় লেখক রুশদি যতটা না পরিচিত তার সাহিত্যকর্মের জন্য, তার চেয়ে বেশি পরিচিত তাকে ঘিরে বিতর্কের কারণে। তার সাহিত্যকর্মের সঙ্গে অনেকে পরিচিত না হলেও তার নাম শোনেননি এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারণ লেখালেখির জন্য বিশ্বের যে কয়জন লেখক-সাহিত্যিক মৃত্যুর হুমকি পেয়েছেন, তাদের একজন রুশদি। পাঁচ দশকের সাহিত্যজীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কা তিনি খান ১৯৮৮ সালে, তার চতুর্থ উপন্যাস দ্য স্যাটানিক ভার্সেসের জন্য। এটি রুশদির সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাস। দ্য স্যাটানিক ভার্সেস বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তোলে, যা এখনো থামেনি। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্ব তার এই বইয়ের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়, ক্ষোভে ফেটে পড়ে তারা। তাদের ভাষ্য, দ্য স্যাটানিক ভার্সেসে সালমান রুশদি মহানবী হজরত মুহাম্মদকে (সা.) যেভাবে উপস্থাপন করেছেন, তা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে গভীরভাবে আঘাত হেনেছে। বিশ্বের অনেক দেশ বইটি নিষিদ্ধ করে। একের পর এক মৃত্যুর হুমকি পেয়ে রুশদি একপর্যায়ে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। তার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে ব্রিটিশ সরকার তাকে পুলিশি পাহারায় রাখে। বিতর্কিত বইটি প্রকাশের এক বছর পর ১৯৮৯ সালে ইরানের তৎকালীন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক রুশদির মৃত্যুদণ্ডের ফতোয়া জারি করেন। তাকে হত্যা করতে মুসলিম বিশ্বের প্রতি আহ্বান জানান খোমেনি।
এ ছাড়া রুশদিকে যে হত্যা করবে, তাকে প্রায় ৩০ লাখ ডলার পুরস্কারেরও ঘোষণা দেয় ইরান সরকার। তার আগেই প্রতিবাদের অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল ইরান। পশ্চিমা বিশ্বের লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা ইরানের সর্বোচ্চ নেতা খোমেনির ফতোয়ার কঠোর নিন্দা জানান। তারা এটিকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হিসেবে দেখেন। সে সময় থেকে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে কড়া নিরাপত্তায় ছিলেন রুশদি। সেই নিরাপত্তার চাদর শেষ পর্যন্ত ভাঙতে সফল হয় একজন উগ্রপন্থি। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের পশ্চিমাঞ্চলে চৌতাকুয়া ইনস্টিটিউশন নামের এক শিক্ষাকেন্দ্রে অনুষ্ঠানে অংশ নেন রুশদি। মঞ্চে ওঠার পর হঠাৎ এক ব্যক্তি তার ওপর হামলে পড়ে তার ঘাড় ও পেটে ছুরি দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে। ৭৫ বছর বয়সী রুশদিকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে নেওয়া হয়। তার এজেন্ট অ্যান্ড্রু ওয়াইলি পরে জানান, জখমের কারণে রুশদির যকৃৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হাতের স্নায়ু ছিঁড়ে গেছে এবং তার একটি চোখ দৃষ্টিশক্তি হারাতে পারে। এদিকে নিউ ইয়র্কে রুশদির নিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন মহল।
শৈশব ও লেখালেখি
সালমান রুশদির পুরো নাম আহমেদ সালমান রুশদি। ১৯৪৭ সালের ১৯ জুন ব্রিটিশশাসিত ভারতের বোম্বে শহরে (বর্তমানে মুম্বাই) এক কাশ্মীরি মুসলমান পরিবারে জন্ম হয় তার। রুশদির বাবা আনিস আহমেদ রুশদি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা আইনজীবী। পরবর্তী সময়ে তিনি আইন পেশা ছেড়ে ব্যবসার দিকে ঝোঁকেন। রুশদির মা নেগিন ভাট শিক্ষক ছিলেন। বোম্বে শহরেই মা-বাবা ও তিন বোনের সঙ্গে বড় হন রুশদি। পড়াশোনা করেন দক্ষিণ বোম্বের ক্যাথিড্রাল অ্যান্ড জন কনন স্কুলে। ১৪ বছর বয়সে তাকে ইংল্যান্ডের রাগবি শহরের রাগবি স্কুলে পাঠানো হয়। পরে কেমব্রিজের নামকরা কিংস কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক পাস করেন তিনি। ব্রিটিশ নাগরিকত্ব পাওয়া রুশদি ক্যারিয়ারের শুরুতে কিছুদিন অভিনয় করেন। এরপর বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কপিরাইটার হিসেবে কাজ করেন তিনি। পাশাপাশি লেখালেখিতেও সময় দিতে থাকেন রুশদি। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম উপন্যাস গ্রাইমাস পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলতে ব্যর্থ হয়, যদিও সমালোচকদের কেউ কেউ তার মধ্যে সে সময় অপার সম্ভাবনা দেখতে পান। ভারতের পটভূমিতে লেখা দ্বিতীয় উপন্যাস মিডনাইট’স চিলড্রেনের কাজ শেষ করতে রুশদির পাঁচ বছর সময় লেগেছিল।
সাহিত্য জগতে ব্যাপক সাড়া ফেলা এই উপন্যাসের পাঁচ লাখ কপি সে সময় বিক্রি হয়। ১৯৮৩ সালে রুশদি তার তৃতীয় উপন্যাস শেইম প্রকাশ করেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশ হয় রুশদির পরাবাস্তববাদী ও পোস্ট মডার্ন উপন্যাস দ্য স্যাটানিক ভার্সেস। এটি প্রকাশের পরপরই বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়, যা দুই মাস পর বড় আকার ধারণ করে। ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাজ্যের ব্র্যাডফোর্ড শহরের মুসলমান বাসিন্দারা বইটির কপি জ্বালিয়ে দেয়। রুশদির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ আনা হয়, যা তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। রুশদির হোমটাউন বোম্বে শহরে বিক্ষোভে ১২ জনের মৃত্যু হয়। ইরানের রাজধানী তেহরানে ব্রিটিশ দূতাবাসে পাথর ছোড়া হয়। যুক্তরাজ্যের কয়েকজন মুসলমান নেতা বিক্ষোভকারীদের শান্ত হতে বললেও বাকিরা ইরানের তৎকালীন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনির রুশদির মাথার দাম ঘোষণার সিদ্ধান্তকে সমর্থন দেন। বিক্ষোভ ও বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে একপর্যায়ে দ্য স্যাটানিক ভার্সেস নিষিদ্ধ করে ভারত। পরে এটি পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি মুসলমান দেশে নিষিদ্ধ হয়।
অনুবাদকদের ওপর হামলা
দ্য স্যাটানিক ভার্সেসের মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন রুশদি। কিন্তু মহানবীকে অপমান করার বদলা থেকে কখনোই সরে আসেনি ইরান। দেশটির বর্তমান সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি তাই একবার বলেছিলেন, আশির দশকে রুশদির নামে যে ফতোয়া জারি করা হয়েছিল, তা কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। রুশদিকে হাতের কাছে না পেলেও দ্য স্যাটানিক ভার্সেসের অনুবাদকদের ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হয়। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে জাপানের রাজধানী টোকিওতে জাপানি অনুবাদক হিতোশি ইগারাশিকে হত্যা করা হয়। তিনি ছিলেন দেশটির সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপারেটিভ কালচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। জাপান পুলিশ জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের কক্ষের বাইরে ইগারাশিকে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। তার গায়ে বেশ কয়েকটি ছুরির আঘাত ছিল। তার হত্যাকারী কে ছিলেন, তা কখনো জানা যায়নি। একই মাসে ইতালির মিলান শহরে দ্য স্যাটানিক ভার্সেসের ইতালি ভাষার অনুবাদক ইত্তোরে ক্যাপ্রিওলোকে তার অ্যাপার্টমেন্টে ছুরিকাঘাত করা হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি মারা যাননি। এ ছাড়া ১৯৯৩ সালে নরওয়ের অনুবাদক উইলিয়াম নিগার্ডকে তার বাড়ির বাইরে গুলি করা হয়। তিনিও বেঁচে গিয়েছিলেন।
রাজীব গান্ধীর প্রতি ক্ষোভ
সালমান রুশদির দ্য স্যাটানিক ভার্সেস প্রথম যে দেশ নিষিদ্ধ করে, তা ছিল ভারত। এ নিয়ে দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর কাছে সে সময় কড়া ভাষায় একটি চিঠি লেখেন রুশদি। সেই চিঠি ১৯৮৮ সালের ১৯ অক্টোবর নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রকাশ করে এবং তার শিরোনাম দেওয়া হয় ‘নিজের স্বার্থে বই নিষিদ্ধ করল ভারত’। চিঠিতে ক্ষুব্ধ রুশদি বলেন, ‘সৈয়দ শাহাবুদ্দীন, খুরশিদ আলম খানসহ ২/৩ জন এমপির অভিযোগ শুনে দ্য স্যাটানিক ভার্সেস নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। এই ব্যক্তিদের আমি উগ্রপন্থি এমনকি মৌলবাদীও বলতে দ্বিধা করি না। তারা আমাকে এবং আমার বইকে আক্রমণ করেছে। তারা বলছেন, আমার বই পড়ার প্রয়োজন তারা বোধ করছেন না। এই ধরনের ব্যক্তিদের ভারত সরকার এত গুরুত্ব দিচ্ছে দেখে আমি প্রচণ্ড বিরক্ত।’ চিঠিতে তিনি আরও বলেন, ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস নিষিদ্ধ করার পক্ষে ভারত সরকার এক বিবৃতিতে বলেছে, বইটির নির্দিষ্ট কয়েকটি অংশ বিকৃত ও অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এটি পড়ে আমি সত্যিকার অর্থে স্তম্ভিত হয়েছি। বিষয়টি অনেকটা এমন একজন নির্দোষ ব্যক্তি ছিনতাইকারীর কবলে পড়তে পারেন বা তাকে ধর্ষণ করা হতে পারে এই আশঙ্কায় তাকে অর্থাৎ সেই নির্দোষ ব্যক্তিকেই জেলে রাখা হচ্ছে তার নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে। জনাব রাজীব গান্ধী, কোনো মুক্ত সমাজ এ ধরনের আচরণ করতে পারে না।’
স্তব্ধ সাহিত্যজগৎ
শুক্রবার নিউ ইয়র্কে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক সালমান রুশদিকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে পড়ে বিশ্বের সাহিত্যজগৎ। হ্যারি পটার সিরিজের রচয়িতা ব্রিটিশ লেখক জেকে রোলিং ও আমেরিকান লেখক স্টিফেন কিং ওই ঘটনাকে ‘ভয়ংকর’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বুকার পুরস্কারজয়ী ইংলিশ লেখক ইয়ান ম্যাকইওয়েন বলেন, ‘এটি মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ভয়াবহ আক্রমণ। দুনিয়াজুড়ে নির্যাতিত লেখক ও সাংবাদিকদের পক্ষে কথা বলেছেন সালমান রুশদি। তার মতো মেধাবী ও সাহসী লেখককে ভয় দেখিয়ে থামানো যাবে না।’ ব্রিটিশ নাট্যকার হানিফ কুরেশি বলেন, ‘রুশদির ওপর হামলা শুনে আমি বিস্মিত ও আতঙ্কিত বোধ করছি। ৩৩ বছর আগের এক ফতোয়া তাকে সবসময় তাড়া করে বেড়িয়েছে।’ ফরাসি ব্যঙ্গাত্মক সাময়িকী শার্লি এবদোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক লরেন্ট সোরিসিউ বলেন, ‘কোনোকিছুই ফতোয়া বা মৃত্যুদণ্ডকে ন্যায্যতা দিতে পারে না।’ ফ্রান্সের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো লরেন্ট সোরিসিউকে নিরাপত্তা দিচ্ছে। ২০১৫ সালে মহানবী হজরত মুহাম্মদকে (সা.) নিয়ে আঁকা কার্টুন শার্লি এবদো প্রকাশ করায় ১৭ জনকে বন্দুকধারীরা গুলি করে হত্যা করে। এদের মধ্যে ১২ জন ছিলেন সোরিসিউর সহকর্মী। রুশদির ওপর হামলা ব্যথিত করে তার বন্ধু ও লেখক লিসা অ্যাপিগনানেসিকে। তিনি বলেন, ‘আশা করি, রুশদি আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন।’ বুকার পুরস্কারজয়ী ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায় বলেন, ‘এই ঘটনা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। রাগ ও দুঃখ আমাকে গ্রাস করেছে। রুশদি পৃথিবীর অনেক লেখকের পাশে দাঁড়িয়েছেন, যারা নানা ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছেন। সেই রুশদির মতো মানুষের সঙ্গে এমনটা হতে পারে জেনে আমরা লেখকরা বিপর্যস্ত বোধ করছি।’