শিরোনাম
গ্রীষ্মের রেকর্ড দাবদাহে শুকিয়ে যাচ্ছে ইউরোপের নদীগুলো। কয়েকশ বছর ধরে জার্মানি, নেদারল্যান্ডস ও সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ রাইন নদী। কিন্তু চলতি সপ্তাহের শেষের দিকে জাহাজ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়তে চলেছে এর একটি প্রধান পয়েন্ট। মধ্য ইউরোপের সঙ্গে কৃষ্ণসাগরের সংযোগ ঘটানো দানিউব নদীর পানিও দ্রুত কমে যাচ্ছে। এর ফলে ইউরোপের জ্বালানি-শস্যসহ অন্যান্য বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইউরোপে কেবল নদী-ভিত্তিক পরিবহন ব্যবস্থাই সংকটে নয়, তৈরি হয়েছে আরও নানা সমস্যা। রোন ও গ্যারোন নদীর পানির তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তা দিয়ে পারমাণবিক চুল্লিগুলো যথেষ্ট শীতল করতে পারছে না ফ্রান্স। এতে দেশটিতে বৈদ্যুতিক সংকট আরও বেড়ে গেছে। ইতালির পো নদীতে পানি কমে যাওয়ায় ধানক্ষেতে সেচ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
ইউরোপের প্রাণ
ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুসারে, ইউরোপের নদী ও খালগুলো সেখানকার প্রত্যেক বাসিন্দার জন্য বছরে অন্তত এক টন মালামাল পরিবহন করে এবং এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে প্রায় আট হাজার কোটি মার্কিন ডলার অবদান রাখে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে এমনিতেই মারাত্মক জ্বালানি ঘাটতিতে ভুগছে ইউরোপ। এরমধ্যে নদীগুলোর নাব্য সংকট তাদের জন্য আরও বড় বিপদ ডেকে এনেছে।
এবিএন আমরো ব্যাংক এনভির পরিবহন অর্থনীতিবিদ অ্যালবার্ট জান সোয়ার্টের মতে, ২০১৮ সালে রাইন নদীর ট্রানজিট সমস্যার কারণে ৫০০ কোটি ইউরো (৫১০ কোটি ডলার) ক্ষতি হয়েছিল ইউরোপের। কিন্তু এবার এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে এর প্রভাব আরও গুরুতর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রচুর বৃষ্টিপাত না হওয়া পর্যন্ত এ অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ শিপিং সক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। জার্মানিতে বিদ্যুতের চড়া দামের কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ আমরা এখানে কয়েকশ কোটির (ডলার/ইউরো) কথা বলছি।
রাইনের দুর্দশা
ইউরোপের অভ্যন্তরীণ জলপথ নেটওয়ার্কের প্রাণ হলো রাইন নদী। প্রায় ৮০০ মাইল দীর্ঘ নদীটি সুইজারল্যান্ডের পার্বত্য এলাকায় উৎপত্তি হয়ে অন্তত ইউরোপের ছয়টি দেশের ভেতর দিয়ে দিয়ে উত্তর সাগরে গিয়ে পড়েছে। খালের মাধ্যমে এর সঙ্গে সংযোগ ঘটেছে দানিউব নদীরও।
জার্মানির পরিবহন ব্যবস্থার জন্য রাইন নদী খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পানির স্তর নামতে থাকায় এটি দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম তৈরি হয়েছে। রাইন গর্জের দক্ষিণ প্রান্তে সোপানযুক্ত এলাকাগুলো বাদামি বর্ণ ধারণ করেছে। কোলোনে একটি জনপ্রিয় ভাসমান রেস্তোঁরা এখন মাটিতে গিয়ে ঠেকেছে৷ কাউব শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার উজানে একটি চর জেগে উঠেছে।
ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের পশ্চিমে নদীটির গভীরতা আগামী শুক্রবার (১২ আগস্ট) ৪০ সেন্টিমিটারে (১৬ ইঞ্চির কাছাকাছি) নেমে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। পানির ওই স্তরে বড় মালবাহী জাহাজ চলাচল কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। জার্মান ফেডারেল ওয়াটারওয়েজ অ্যান্ড শিপিং অ্যাডমিনিস্ট্রেশন গত বুধবার জানিয়েছে, শনিবার রাইন নদীর পানির স্তর ৩৭ সেন্টিমিটারে নেমে যেতে পারে।
সংকটে ইউরোপের বাণিজ্য
ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের পণ্য পরিবহনের জন্য রাইন নদী অপরিহার্য। জলপথ বন্ধ হলে তার প্রভাবে জার্মানির রেল নেটওয়ার্ক দীর্ঘস্থায়ী জটের সম্মুখীন হবে। চাপ সড়কপথে সরিয়ে নেওয়াও সহজ নয়। একটি গড়পরতা জাহাজের সমান মালামাল পরিবহনে ১১০টির বেশি ট্রাকের প্রয়োজন এবং জার্মানি এমনিতেই ৮০ হাজার ট্রাকচালকের ঘাটতিতে ভুগছে। রুশ আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়তে ইউক্রেনীয়রা স্বদেশে ফিরে যাওয়ায় এ সমস্যা আরও গুরুতর হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম ঊর্ধ্বমুখী, তার ওপর রাশিয়া থেকে আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে জার্মানি। এর মধ্যে নদীপথ বন্ধ হয়ে গেলে দেশটির বিদ্যুৎ উৎপাদকরা যে ভয়াবহ সংকটে পড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
শুধু জার্মানি নয়, গোটা ইউরোপেই ছড়িয়ে পড়েছে রাইন-সম্পর্কিত সমস্যা। সুইজারল্যান্ডে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ২০১৭ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। ঘাটতি মেটাতে জ্বালানির মজুত ব্যবহার করতে হচ্ছে দেশটিকে। একই কারণে নেদারল্যান্ডসে ফেরি চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। এতে বেশ কিছু এলাকায় যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ইতিহাসের ভয়াবহতম খরার কারণে ফ্রান্সের বেশিরভাগ অংশে পানি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হয়েছে। দেশটির ১০০টির বেশি পৌরসভায় এখন ট্রাকের সাহায্যে খাবার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
নদীর পানির উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ায় তা দিয়ে ফ্রান্সের পারমাণবিক চুল্লিগুলো যথেষ্ট শীতল করা সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে চলতি সপ্তাহে পাঁচটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে নদীতে গরম পানি ছাড়ার অনুমতি দিয়েছেন ফরাসি নীতিনির্ধারকরা, যা তাদের পরিবেশগত মানদণ্ডের বিরোধী।
ইতালির মোট কৃষি উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশই হয় পো নদীর উপত্যকায়। তবে এর পানির স্তর ৭০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যাওয়ায় ওই অঞ্চলে ভুট্টা, সূর্যমুখীসহ সব ধরনের শস্য উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও সার্বিয়ায় দানিউব নদীতে জরুরি ভিত্তিতে ড্রেজিং কার্যক্রম চলছে। চ্যানেলগুলো উন্মুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য জাহাজ।
রোমানিয়ার নদীপথের বৃহত্তম জাহাজ কোম্পানি ট্রান্সপোর্ট ট্রেড সার্ভিসেসের অন্যতম পরিচালক গ্যাব্রিয়েল তেচেরা বলেন, গত ২০ বছরের মধ্যে এটিই আমাদের সবচেয়ে গুরুতর পরিস্থিতি।
ডুনাভ ট্যুরস এডি’র ট্যুরিস্ট সার্ভিসের প্রধান রোসেন ওসেনভ বলেন, আমাদের এখন বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে হবে।
(ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অবলম্বনে)
সৌজন্যে: জাগো নিউজ