শিরোনাম
৪১ বছর বয়সী চীনা নাগরিক ইয়াং হুইয়ান। তিনি শুধু চীনেই নয়, পুরো এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ধনী নারী। এক দশকের বেশি সময় আগে বাবার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে একটি রিয়েল এস্টেট সাম্রাজ্যের মালিক হওয়ার পর থেকে তার সম্পদ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কিন্তু ২০২১ সালে হঠাৎই বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি।
গত বছর সত্যিকারে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন ইয়াং হুইয়ান। ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার্স ইনডেক্সের হিসাবে, এই এক বছরে তার সম্পত্তি ৫২ শতাংশেরও বেশি কমে গেছে। ব্লুমবার্গ গত বছর এ নারী ব্যবসায়ীর সম্পত্তির হিসাব করেছিল ৩ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। চলতি বছর জুলাই মাসে তার পরিমাণ নেমে গেছে ১ হাজার ৬১০ কোটি ডলারে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা একে শুধু চীনের রিয়েল এস্টেট বাজারের মন্দার চিহ্ন হিসেবেই নয়, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি বড় সতর্কবার্তা হিসেবেও দেখেছেন।
কীভাবে সেরা ধনী হলেন ইয়াং হুইয়ান?
ইয়াং হুইয়ানের জন্ম ১৯৮১ সালে দক্ষিণ চীনের ক্যান্টন প্রদেশের ফোশান শহরে। তারা বাবা চীনের অন্যতম ধনী ইয়াং গুওচিয়াং। দেশটির অন্যতম প্রভাবশালী পরিবারে বেড়ে ওঠা ইয়াংয়ের শিক্ষাজীবনও ছিল দুর্দান্ত।
তরুণ বয়সে তাকে পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ২০০৩ সালে তিনি ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে কলা ও বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
চীনে ফেরার পর ২০০৭ সালে বাবার কাছ থেকে কান্ট্রি গার্ডেন হোল্ডিংসের অধিকাংশ শেয়ার উত্তরাধিকার সূত্রে পান। জমি বিক্রির দিকে থেকে প্রতিষ্ঠানটি ছিল চীনের বৃহত্তম রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার।
১৯৯২ সালে গুয়াংঝৌতে প্রতিষ্ঠার পর কান্ট্রি গার্ডেন হোল্ডিংস হংকংয়ের বাজারে শেয়ার ছেড়ে খুবই সফল হয় এবং ১৬০ কোটি ডলার সংগ্রহ করে। এটি ছিল ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারে গুগলের আইপিওতে অর্জিত অর্থের সমান।
ইয়াং হুইয়ান বরবরই নিভৃত ও সাদামাটা জীবনযাপনের জন্য পরিচিত। কিন্তু চীনের ভেতরে ও বাইরে অসংখ্যবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন তিনি।
২০১৮ সালে ইয়াংকে ঘিরে বেশ বড় একটি কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। সেসময় ‘সাইপ্রাস পেপারস’ নামে পরিচিত ফাঁস হওয়া দলিলপত্র থেকে জানা যায়, ইয়াং হুইয়ান ওই বছর সাইপ্রাসের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন, যদিও চীনের আইন অনুযায়ী দ্বৈত নাগরিকত্ব বৈধ নয়।
চীনা বাজার সম্পর্কে অভিজ্ঞরা ইয়াং হুইয়ানকে প্রখর ব্যবসায়িক জ্ঞানসম্পন্ন সৃজনশীল নারী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। গত বছর জুন মাসে ইন্টারন্যাশনাল হসপিটালিটি ইনস্টিটিউট তাকে বিশ্বব্যাপী হসপিটালিটি শিল্পের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় স্থান দিয়েছিল।
কিন্তু ততদিনে তার ব্যবসায় দুর্বলতার লক্ষণও প্রকাশ পেতে শুরু করে। ২০২০ সাল থেকে চীনের রিয়েল এস্টেট বাজারের পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হতে থাকে। এটি শুধু করোনাভাইরাস মহামারির কারণে নয়, রিয়েল এস্টেট খাতে অতিরিক্ত যে ঋণের বোঝা তৈরি হয়েছে, চীনা কর্তৃপক্ষ তা সামলানোর চেষ্টা শুরু করে।
এর ফলে বৃহৎ নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার আর্থিক সাহায্য দিয়ে ঋণদাতা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নতুন করে দরকষাকষি করতে বাধ্য করে। এই সংকট আরও তীব্র হয় চীনের সবচেয়ে ঋণগ্রস্ত রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এভারগ্রান্ডেকে ঘিরে। মাসের পর মাস তারল্য সংকটের পর ২০২১ সালের শেষের দিকে প্রতিষ্ঠানটি ডলার বন্ডেও খেলাপি হয়ে যায়।
ওই ঘটনার পর চলতি বছর কাইসা এবং শিমাও গ্রুপসহ আরও কয়েকটি বড় ডেভেলপার দেউলিয়া হয়েছে। ‘ক্রেতা ধর্মঘট’র খবর ছড়ালে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সংকট আরও তীব্র আকার ধারণ করে। বাড়ি নির্মাণে দেরি হওয়ার অভিযোগে হাজার হাজার মানুষ বন্ধকির অগ্রিম অর্থ জমা দিতে অস্বীকৃতি জানান।
এর মধ্যেও কান্ট্রি গার্ডেন করোনা মহামারির প্রথম দিনগুলোতে চালু ছিল। কিন্তু এরপর নগদ অর্থ সংকটে পড়ে তারা। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রতিষ্ঠানটি অতিরিক্ত তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে গত জুলাই মাসে প্রায় ১৩ শতাংশ ছাড়ে শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
কিন্তু এসবের পর ইয়াং হুইয়ান ও তার প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল নয় বলেই মনে করা হচ্ছে। গত জুলাইয়ের এক প্রতিবেদনে ক্রেডিট রেটিং সংস্থা এসঅ্যান্ডপি পূর্বাভাস দিয়েছে, মর্টগেজ ক্রেতাদের ধর্মঘটের কারণে চীনে রিয়েল এস্টেট বিক্রি এ বছর এক-তৃতীয়াংশ কমে যেতে পারে।
ক্যাপিটাল ইকোনমিক্স নামে লন্ডনের একটি স্বাধীন অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থাও ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, বিক্রি কমে গেলে আরও অনেক ডেভেলপার মুখ থুবড়ে পড়বে এবং সেটি হবে চীনের জন্য একটি বড় অর্থনৈতিক হুমকি।
সূত্র: বিবিসি বাংলা