শিরোনাম
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় একের পর এক বোমা হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। হামলায় এখন পর্যন্ত ৩১ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের (পিআইজে) এক জ্যেষ্ঠ নেতাও। গত শুক্রবার তাঁকে লক্ষ্য করে হামলা চালায় ইসরায়েল।
গাজায় বোমা হামলা শুরুর পর ইসলামিক জিহাদ নিয়ে কথা বলেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদ। তাঁর ভাষ্যমতে, ইসলামিক জিহাদকে সহায়তা করছে ইরান। ইসরায়েলকে ধ্বংস করাই এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য।
গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের মতো ইসলামিক জিহাদের হাতে দূরপাল্লার রকেট নেই। তবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ছোট ছোট সমরাস্ত্র, মর্টার, রকেট ও ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। এ ছাড়া আল-কুদস ব্রিগেড নামে তাদের একটি সশস্ত্র শাখাও রয়েছে।
এ নিয়ে কাতারের দোহা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইব্রাহিম ফ্রাইহাত আল-জাজিরাকে বলেন, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিপ্রক্রিয়া ও আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করার কারণে ইসলামিক জিহাদের পরিচিতি রয়েছে। হামাসের মতো তারাও ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছে। আর ইরানের সঙ্গে গোষ্ঠীটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তেহরানের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা, গাজায় ইসরায়েলের চলমান হামলার একটি কারণ বলে আমরা মনে করছি।’
ইসলামিক জিহাদের শুরু হবে থেকে, তাদের লক্ষ্য কী, কাদের সহায়তায় তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়ছে, আর তাদের শক্তিমত্তাই–বা কতটুকু, তা তুলে ধরা হয়েছে আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে।
ইসলামিক জিহাদের জন্ম
ইসলামিক জিহাদ গড়ে ওঠে ১৯৮১ সালে, মিসরে অবস্থানকারী একদল ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীর হাত ধরে। তাঁদের লক্ষ্য ছিল গাজা, ইসরায়েলের দখল করা পশ্চিম তীর ও যে ভূখণ্ডটি এখন ইসরায়েল নামে পরিচিত—সেসব অঞ্চল নিয়ে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের প্রধান যে দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে, তার মধ্যে একটি ইসলামিক জিহাদ, অপরটি হামাস। তবে সক্ষমতা ও আকারের দিক দিয়ে হামাসের চেয়ে তুলনামূলক বেশ ছোট ইসলামিক জিহাদ।
আকারে ছোট হলেও ইসলামিক জিহাদ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সব লড়াইয়ে অংশ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন ইব্রাহিম ফ্রাইহাত। তিনি বলেন, ‘ইসলামিক জিহাদ অত্যন্ত দক্ষ আর সংগঠিত একটি গোষ্ঠী। তাদের ভেতরে শৃঙ্খলাব্যবস্থা খুবই শক্তিশালী।’
কমান্ডার নিহত
ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অন্যতম একটি শক্তি হয়ে উঠেছে ইসলামিক জিহাদ। এর জের ধরে গত শুক্রবার গোষ্ঠীটির জ্যেষ্ঠ নেতা ও গাজার উত্তরাঞ্চলের কমান্ডার তায়সির আল-জাবারি ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিহত হন।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ বলছে, ইসলামিক জিহাদের সদস্য সংখ্যা কত, তা সুনিশ্চিতভাবে বলা কঠিন। তবে সংখ্যাটা এক হাজার থেকে কয়েক হাজার পর্যন্ত হতে পারে বলে গত বছর একটা ধারণা করা হয়েছিল।
২০০৯ সাল থেকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাঁচটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে হামাস। গোষ্ঠীটিকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে কালোতালিকায় ফেলেছে পশ্চিমা দেশগুলো। একই তালিকায় রয়েছে ইসলামিক জিহাদও। অর্থ ও সমরাস্ত্র দিয়ে দুটি গোষ্ঠীরই পাশে দাঁড়িয়েছে ইরান। এমনকি ইসরায়েলের হামলার মধ্যেই ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে দেখা করেছেন ইসলামিক জিহাদের নেতা জিয়াদ আল-নাখালাহ।
তবে হামাসের মতো রাজনীতিতে নামার আকাঙ্ক্ষা দেখায়নি ইসলামিক জিহাদ, অংশ নিতে রাজি হয়নি কোনো নির্বাচনেও। এসবের জেরে বিশ্লেষকদের অনেকের এটাই মনে হয়েছে, গাজা কিংবা পশ্চিম তীরে সরকার গঠনের পথে হাঁটার কোনো ইচ্ছা নেই গোষ্ঠীটির।
প্রশিক্ষণ ও তহবিল সংগ্রহ
ইসলামিক জিহাদকে পরামর্শ, প্রশিক্ষণ ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করে আসছে ইরান। তবে গোষ্ঠীটির বেশির ভাগ অস্ত্রই স্থানীয়ভাবে তৈরি।
ইসলামিক জিহাদ মূলত গাজাভিত্তিক হলেও লেবানন ও সিরিয়ায় তাদের নেতাদের উপস্থিতি রয়েছে। ইরানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলছেন তাঁরা। ইরানের সামরিক বাহিনীর শাখা রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের প্রধান বলেছেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ফিলিস্তিন ‘একা নয়।’
ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশে রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি বলেন, ‘এই লড়াইয়ের শেষ পর্যন্ত আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি। আমরা ফিলিস্তিনিদের জানিয়ে দিতে চাই, তাঁরা একা নন। সম্প্রতি করা অপরাধের জন্য ইসরায়েলকে আরেকটি চড়া মূল্য দিতে হবে।’
আগেও ইসরায়েলের হামলায় নিহত হয়েছেন ইসলামিক জিহাদের নেতারা
২০১৯ সালে ইসরায়েলি বাহিনীর এক হামলায় বাহা আবু এল-আতা নামে ইসলামিক জিহাদের এক নেতা নিহত হন। এরপর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন শুক্রবার নিহত হওয়া তায়সির আল-জাবারি। ২০১৪ সালে গাজা যুদ্ধের পর থেকে আবু এল-আতা ইসলামিক জিহাদের প্রথম প্রভাবশালী কোনো নেতা, যিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
আল-জাবারি ইসলামিক জিহাদের ‘মিলিটারি কাউন্সিলের’ সদস্য ছিলেন। এই কাউন্সিল গাজা উপত্যকায় গোষ্ঠীটির পক্ষে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এ ছাড়া ২০২১ সালে ইসরায়েলের হামলার সময় আল-জাবারি গাজা শহর ও উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে ইসলামি জিহাদের কর্মকাণ্ড দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। ইসরায়েলের ওই হামলা ১১ দিন ধরে চলেছিল। এ সময় গাজায় ২৬০ জন এবং ইসরায়েলের ১৩ জনের মৃত্যু হয়।
পশ্চিম তীরে উপস্থিতি
ইসরায়েলের দখল করা পশ্চিম তীরের জেনিন শহরেও ইসলামিক জিহাদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি রয়েছে। গত সপ্তাহে ওই শহর থেকে গোষ্ঠীটির জ্যেষ্ঠ নেতা বাসাম আল-সাদিকে গ্রেপ্তার করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
এ ছাড়া পশ্চিম তীর থেকে ইসলামিক জিহাদের আরও ১৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে গতকাল শনিবার জানিয়েছে ইসরায়েল সরকার। বিদেশে অবস্থান করা গোষ্ঠীটির নেতাদেরও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গান্তজ।
দোহা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইব্রাহিম ফ্রাইহাতের ভাষায়, ‘পশ্চিম তীরে ইসলামিক জিহাদের উপস্থিতি রয়েছে, আমি বলব, অনেকটা গাজার মতোই। সেখানে তাদের আকার কেমন, সেটা বিষয় নয়। বিষয়টি হলো তাদের শক্তি, দক্ষতা এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোদ্ধাদের মাঠে নামানোর সক্ষমতা। আর এ কারণেই পশ্চিম তীরে ইসলামিক জিহাদের নেতাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে ইসরায়েল।’
বাসাম আল-সাদিকে গ্রেপ্তার
পশ্চিম তীর থেকে গ্রেপ্তার হওয়া বাসাম আল-সাদির বয়স ৬২ বছর। ইসলামিক জিহাদের সদস্য হওয়ার কারণে ১৫ বছর তাঁকে ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগারে কাটাতে হয়েছে। ইসরায়েলের হাতে নিহত হয়েছেন তাঁর দুই ছেলেও।
আল-সাদির ওই দুই ছেলে ইসলামিক জিহাদের সদস্য ছিলেন। ২০০২ সালে আলাদা দুটি ঘটনায় তাঁদের হত্যা করা হয়। একই বছরে পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে যুদ্ধের সময় আল-সাদির বাড়ি ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েলি বাহিনী।
ইসলামিক জিহাদের পরিকল্পনা
গাজায় ইসরায়েলি বোমা হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইসলামিক জিহাদের নেতা জিয়াদ আল-নাখালাহ। ইসরায়েলের রাজধানী তেল আবিবসহ অন্য শহরগুলোতে হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছেন তিনি। এরপর শনিবার সারা রাত ধরে তেল আবিবে একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
হুঁশিয়ারি দিয়ে জিয়াদ আল-নাখালাহ বলেন, ‘ইহুদি শত্রুরা এই আগ্রাসন শুরু করেছে। তাদেরও আমাদের কাছ থেকে অবিরাম হামলা আশা করতে হবে। ইসরায়েলের এই বোমা হামলার পর আর কোনো যুদ্ধবিরতি হবে না।’