শিরোনাম
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর ঘিরে একের পর এক কড়া বক্তব্য দিয়েছে চীন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই বক্তব্যের মাধ্যমে তাইওয়ান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত নীতি বিষয়ে বেইজিংয়ের গভীর নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক দুর্দশা জনগণের থেকে আড়াল করতেও এই পথ বেছে নিয়েছে চীন।
গত মঙ্গলবার রাতে চীনের কড়া হুঁশিয়ারির পরও তাইওয়ান সফরে আসেন ৮২ বছর বয়সী পেলোসি। ২৫ বছরের মধ্যে তাইওয়ান সফর করা সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ মার্কিন রাজনীতিবিদ তিনি।
রাজধানী তাইপের একটি বিমানবন্দরে পেলোসির সামরিক উড়োজাহাজ অবতরণের কয়েক দিন আগে থেকেই আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করে আসছিল বেইজিং। তাইওয়ান সফর করলে পরিণাম ভোগ করার হুমকি দেওয়াসহ সামরিক শক্তি প্রদর্শনও করেছিল চীন। তাইওয়ান প্রণালিতে গত কয়েক দিনে সামরিক মহড়াও করেছে দেশটি। চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস-এর সাবেক প্রধান সম্পাদক হু সিজিন বলেছিলেন, বেইজিং জোরপূর্বক পেলোসির উড়োজাহাজকে সরিয়ে দিতে পারত বা গুলি করে ভূপাতিত করতে পারত।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বেইজিংয়ের এই রুদ্রমূর্তির পেছনে ছিল তাদের নিরাপত্তা-উদ্বেগ। তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার এবং দ্বীপটির স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের ক্রমবর্ধমান প্রচেষ্টাকে চীনের শাসকেরা হুমকি হিসেবে দেখে আসছেন। একই সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং নিজেদের সামরিক ও অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শনে তৎপর ছিলেন। এর পেছনে অবশ্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল। কিছুদিনের মধ্যে বেইজিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে তৃতীয় মেয়াদে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সুরক্ষিত করতে চান সি। সেই সম্মেলনের আগে শক্তি দেখাতে চেয়েছিলেন সি।
গত সপ্তাহে সি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপে যুক্তরাষ্ট্রকে তাইওয়ান প্রসঙ্গে ‘আগুন নিয়ে না খেলতে’ সতর্ক করেছিলেন। লন্ডনের এসওএএস চায়না ইনস্টিটিউটের পরিচালক স্টিভ সাং বলেন, সামনে ২০তম পার্টি কংগ্রেসে ক্ষমতা সুসংহত করার আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বার্তাটি সির অভ্যন্তরীণ ভাবমূর্তিকে শক্তিশালী করতে কাজ করবে। সি যে জিনিসটি দেখাতে চান তা হলো, তাঁদের দুর্বলতার কোনো লক্ষণ নেই।
জাতীয়তাবাদী আবেগের ঢাক পেটানোর আরেক অর্থ হচ্ছে, চীনের মন্থর অর্থনীতি থেকে জনগণের মনোযোগ ফেরানো। এ ছাড়া বেইজিংয়ের কঠোর শূন্য কোভিড বিধিনিষেধে অধৈর্য জনগণের মেজাজ ঠিক করা। হংকংভিত্তিক চীনা রাজনৈতিক বিশ্লেষক উইলি লাম বলেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জন্য বৈধতার দুটি স্তম্ভ রয়েছে। একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আরেকটি হলো জাতীয়তাবাদ। তিনি বলেন, তাইওয়ান নিয়ে বিভিন্ন শিরোনাম এবং আক্রমণাত্মক বার্তা দিয়ে চীনের অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তাইওয়ানের প্রতি ওয়াশিংটনের পরিবর্তনশীল মনোভাব নিয়ে বেইজিংয়ের গভীর উদ্বেগ রয়েছে। তাইওয়ানকে নিজের ভূখণ্ড মনে করে বেইজিং। প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে এর দখল নিতে চায়। কিন্তু তাইওয়ান নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র মনে করে।
সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক লি মিংজিয়াং বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাইওয়ানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা আরও বেড়েছে। এটি চীনে স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধারণা থেকে বেইজিংয়ের সামরিক হুমকির বিষয়টি সামনে এসেছে। তিনি আরও বলেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট
ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সময় থেকেই বেইজিং ধারণা করছে, ওয়াশিংটন ক্রমে তাইওয়ানের স্বাধীনতার সমর্থনকারী হয়ে উঠেছে। চীনা কূটনীতিকেরা ওয়াশিংটন এবং তাইপের মধ্যে অস্ত্র চুক্তির দিকে ইঙ্গিত করে অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র আর ‘এক চীন নীতিকে’ সম্মান দেখাচ্ছে না। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের তাইওয়ানে সফরও বেড়েছে।
হংকংভিত্তিক বিশ্লেষক লাম বলেন, গত বছর থেকেই সি খুব বিরক্ত হচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতাদের ঘন ঘন তাইওয়ান সফর এই বিরক্তির কারণ। একই সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে স্বতন্ত্র তাইওয়ানি পরিচয়ের বোধ তৈরি হচ্ছে। এটিও তাঁর বিরক্তির কারণ।
বেইজিংয়ের আক্রমণাত্মক ভঙ্গি সত্ত্বেও খুব কম লোকই বিশ্বাস করে যে তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সঙ্গে বেইজিং সক্রিয় সামরিক সংঘাতে যেতে চায়। তাইওয়ানের ন্যাশনাল সান ইয়াত-সেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক তিতাস চেন বলেন, সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে সি অনিচ্ছাকৃত যুদ্ধ উসকে দিতে চান। তিনি আরও বলেন, পেলোসির তাইওয়ান সফর বেইজিংয়ের জন্য যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা কাটাতে সির বিকল্প পরিকল্পনা হচ্ছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা চালানো।