রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে তুর্কি ড্রোন

ফানাম নিউজ
  ৩০ জুলাই ২০২২, ১১:৫৫

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে হাজার হাজার ড্রোন। এসব ড্রোন দিয়ে শত্রুদের অবস্থান শনাক্ত করা থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া এমনকি গোলা হামলাও চালানো হচ্ছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার হাতে কোন কোন ড্রোন আছে, এসব ড্রোন কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে সে বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

যুদ্ধে ইউক্রেনের ব্যবহার করা প্রধান সামরিক ড্রোনটি তুরস্কের তৈরি, নাম বেরাকতার টিবি২। এর আকৃতি একটি ছোট উড়োজাহাজের মতো। ড্রোনটিতে ক্যামেরা রয়েছে। আর দরকার পড়লে ড্রোনটি থেকে লেজার গাইডেড বোমাও ছোড়া যায়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের (রুসি) গবেষক জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, ইউক্রেন ৫০টিরও কম বেরাকতার টিবি২ ড্রোন নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছিল। অপরদিকে যুদ্ধে রাশিয়া ছোট আকৃতির অরলান–১০ ড্রোন ব্যবহার করছে। সেগুলোতেও ক্যামেরা আছে, আর ছোট বোমা বহন করতে পারে।

রাশিয়া কয়েক হাজার অরলান–১০ নিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করেছিল। তবে তাদের কাছে এখন মাত্র কয়েক শ ড্রোন অবশিষ্ট আছে, বলেন জ্যাক ওয়াটলিং।

সামরিক ড্রোনগুলো কতটা সক্ষম

জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, অরলান–১০ ড্রোনের সহায়তায় কোনো লক্ষ্যবস্তু খুঁজে পাওয়ার তিন থেকে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেখানে হামলা চালাতে পারে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী। ড্রোনগুলোর সহায়তা ছাড়া একই ধরনের হামলা চালাতে ২০ থেকে ৩০ মিনিট লাগত।

এদিকে ড্রোনের ব্যবহার রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের সীমিত সামরিক শক্তিকে বাড়িয়ে তুলেছে বলে উল্লেখ করেছেন লন্ডনের কিংস কলেজের প্রতিরক্ষা বিদ্যার গবেষক ড. মারিনা মিরন। তিনি বলেন, ‘আগে যদি আপনি শত্রুদের অবস্থান বের করতে চাইতেন, তাহলে আপনাকে বিশেষ বাহিনী পাঠাতে হতো। এতে সেনা সদস্যদের হারানোর সম্ভাবনা থাকত। এখন আপনাকে যে জিনিসটিকে ঝুঁকিতে ফেলতে হবে, তা হলো একটি ড্রোন।’

যদিও রাশিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অনেক বেরাকতার ড্রোন ধ্বংস করেছে। জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, এই ড্রোনগুলো আকারে বড়, আর গতিও তুলনামূলক কম। বেরাকতার বেশি উচ্চতায় উড়তে পারে না। ফলে এগুলো গুলি করে নামানো সহজ।

সামরিক ড্রোনগুলোর দাম আকাশছোঁয়া। তুরস্কের তৈরি একটি বেরাকতার টিবি২ ড্রোনের দাম প্রায় ২০ লাখ ডলার। ফলে দুই পক্ষই—বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে ছোট আকৃতির বাণিজ্যিক ড্রোন ব্যবহারের দিকে ঝুঁকেছে। এর মধ্যে রয়েছে ডিজিআই ম্যাভিক–৩ মডেলের ড্রোন। এগুলোর প্রতিটির দাম প্রায় ১ হাজার ৭০০ ইউরো।

ইউক্রেনের একটি ড্রোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশটির সামরিক বাহিনীর হাতে ৬ হাজার ড্রোন রয়েছে। তবে এ তথ্য আদৌ সঠিক কি না তা নিশ্চিত করা অসম্ভব।

যুদ্ধ শুরুর পর কয়েক সপ্তাহ ইউক্রেনের বেরাকতার ড্রোন বেশ সুনাম কুড়িয়েছিল। মারিনা মিরন বলেন, এই ড্রোনগুলো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার সক্ষমতা দেখিয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ মস্কোভা ডুবিয়ে দিতেও ভূমিকা রেখেছে।

বাণিজ্যিক ড্রোনগুলোতে ছোট আকৃতির বোমা সংযোজন করা যায়। তবে, ইউক্রেনে সেগুলো মূলত ব্যবহার করা হচ্ছে শত্রুপক্ষের অবস্থান শনাক্ত করতে। লন্ডনের কিংস কলেজের মারিনা মিরন বলেন, রাশিয়ার মতো ইউক্রেনের হাতে এত সমরাস্ত্র নেই। তবে বাণিজ্যিক ড্রোনের মাধ্যমে শত্রুদের অবস্থান শনাক্ত করা, তারপর সেখানে কামান হামলা চালানোর অর্থ হলো, ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর কাছে যে অস্ত্র আছে, সেগুলোর ভালোই ব্যবহার করছে তারা।

অন্যদিক দিয়েও সামরিক ড্রোনের চেয়ে বাণিজ্যিক ড্রোনের সক্ষমতা কম। যেমন ডিজেআই ম্যাভিক ড্রোনটি মাত্র ৩০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে পারে। সর্বোচ্চ ৪৬ মিনিট পর্যন্ত উড়তে পারে এগুলো। আর এর চেয়ে কম দামি ও ছোট ড্রোনগুলোর সক্ষমতা আরও কম।

যেভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন ঠেকাচ্ছে রাশিয়া–ইউক্রেন

মারিনা মিরন বলেন, সামরিক ড্রোন শনাক্ত করতে রাডার ব্যবহার করছে রুশ বাহিনী। এ ছাড়া বাণিজ্যিক ড্রোন শনাক্তে ব্যবহার করছে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। জিপিএস ব্যবহার করে বাণিজ্যিক ড্রোনগুলোর পরিচালনার কাজ ব্যর্থ করে দিচ্ছে এসব ডিভাইস।

রুশ বাহিনী ইউক্রেনের বাণিজ্যিক ড্রোন এবং এর পরিচালনাকারীদের মধ্যকার যোগাযোগ ব্যবস্থা শনাক্ত ও বাধাগ্রস্ত করতে অ্যারোস্কোপের মতো অনলাইন পদ্ধতিও ব্যবহার করছে। এই পদ্ধতি এসব ড্রোন ধ্বংস করা বা ঘাঁটিতে ফিরিয়ে দেওয়া এবং ড্রোনের তথ্য পাঠানোকে থামিয়ে দিতে পারে।

ইউক্রেনের এক একটি ড্রোন যুদ্ধক্ষেত্রে গড়পড়তা এক সপ্তাহ টিকতে পারছে।

ড্রোন সরবরাহ করছে কারা

হোয়াইট হাউসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রাশিয়া ইরানের কাছ থেকে কেনা ‘শহীদ’ সামরিক ড্রোন ব্যবহার করছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে এ ধরনের ড্রোন ব্যবহার করেছেন ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা।

ইউক্রেনকে ৭০০ এর মতো সুইচব্লেড ‘কামাইকেজ’ সামরিক ড্রোন সরবরাহ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলো বিস্ফোরকভর্তি। লক্ষ্যবস্তু খুঁজে বের না করা পর্যন্ত আকাশে এগুলো উড়তেই থাকে।

ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স ইউক্রেনকে তার স্টারলিংক স্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থার জোগান দিচ্ছে। এ ব্যবস্থা দেশটির বাণিজ্যিক ড্রোনগুলো ও এর পরিচালনাকারীদের মধ্যে একটি নিরাপদ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করছে।

এখন ডিজেআই রাশিয়া বা ইউক্রেন কোনো দেশকেই আর ড্রোন দিচ্ছে না।

ইউক্রেন ২০০ সামরিক ড্রোন কিনতে আর্থিক সহায়তার আহ্বান জানিয়েছিল। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ইউরোভিশন সং কনটেস্টের বিজয়ী কালুশ অর্কেস্ট্রা তাঁর ৯ লাখ ডলার মূল্যের ট্রফি বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ অনুদান হিসেবে দিয়েছেন।