শিরোনাম
২০১৮ সালে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতর সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের দিকে সরাসরি আঙুল তুলেছিলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিস্যেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। এরপর খুব দ্রুত মুসলিম বিশ্বের দুই প্রভাবশালী দেশের সম্পর্কে ধস নামতে শুরু করে। বছরখানেকের মধ্যে তা এতটাই নিচে নেমে যায় যে, সৌদি আরব অনানুষ্ঠানিকভাবে তুরস্কের পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
অন্যদিকে, বহুদিন পর্যন্ত সুযোগ পেলেই সৌদি রাজপরিবারের সমালোচনা করতে ছাড়েননি এরদোয়ান। দুই দেশের সরকারি গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ি চলেছে বহুদিন। কিন্তু গত এপ্রিল মাসে হঠাৎ সৌদি আরব সফরে যান তুর্কি প্রেসিডেন্ট। জেদ্দায় যুবরাজ সালমানের সঙ্গে এরদোয়ানের করমর্দনের ছবি প্রকাশ হওয়ার পর ইঙ্গিত মেলে, হাওয়া বদলাতে শুরু করেছে।
গত কয়েক মাসে দুই দেশের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ব্যবসা, প্লেন চলাচলে বিধিনিষেধ উঠে গেছে। সৌদি আরবে তুর্কি টিভি সিরিজের সম্প্রচার শুরু হয়েছে। দু’দেশের মিডিয়ার পরস্পরের বিরুদ্ধে যে প্রচারণা চলছিল, তা বন্ধ হয়েছে। গত বুধবার (২২ জুন) এরদোয়ানের আমন্ত্রণে যুবরাজ সালমান তুরস্কে যাওয়ার পর এটি আরও পরিষ্কার যে, আঙ্কারা ও রিয়াদের সম্পর্কে জমাটবাঁধা বরফ গলতে শুরু করেছে।
কেন হাত বাড়ালেন এরদোয়ান?
আন্তর্জাতিক রাজনীতি পর্যবেক্ষকদের কোনো সন্দেহ নেই যে, প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানই সৌদি আরবের সঙ্গে নতুন করে সুসম্পর্ক তৈরিতে উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন। লন্ডনে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশন্যাল ইন্টারেস্টের প্রধান সাদি হামদি বলেন, এরদোয়ান কিছুটা হলেও নতজানু হয়েছেন। বিশেষ করে, গত কয়েক মাস সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে চিড় ধরা সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে তিনি উঠেপড়ে লেগেছেন।
কিন্তু এরদোয়ানের মনোভাবে হঠাৎ কেন এই পরিবর্তন? সাদি হামদি মনে করেন, প্রথম ও প্রধান কারণ হচ্ছে, তুরস্কের অর্থনৈতিক সংকট। তুর্কি মুদ্রা লিরা একরকম মুখ থুবড়ে পড়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবর অনুসারে, ২০২১ সালে মাত্র এক বছরেই মার্কিন ডলারে বিপরীতে লিরার মূল্যমান অর্ধেক হয়ে গেছে। দেশটিতে মুদ্রাষ্ফীতির হার ৭০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
হামদি বলেন, নির্বাচনের মাত্র এক বছর বাকি। এ অবস্থায় উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে, বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে বিনিয়োগ ফিরিয়ে এনে অর্থনৈতিক সংকট কিছুটা হলেও সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট।
গত সপ্তাহে এরদোয়ান পরিষ্কার বলেছেন, তিনি এবং সৌদি যুবরাজ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে কতটা উচ্চতায় নেওয়া সম্ভব তা নিয়ে কথা বলবেন। তুর্কি সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, সৌদি যুবরাজের সফরে দুই দেশের সম্পর্ক সংকট পূর্বকালীন (খাশোগি হত্যাকাণ্ডের আগে) অবস্থায় ফিরবে এবং পুরোপুরি স্বভাবিক হবে।
জানা গেছে, যুবরাজের সফরকালে জ্বালানি, ব্যবসা এবং নিরাপত্তা বিষয়ে তুরস্ক-সৌদি আরবের মধ্যে চুক্তি হবে। সেই সঙ্গে, তুর্কি শেয়ারবাজারে সৌদি বিনিয়োগ এবং সৌদি আরবের কাছে তুরস্কের তৈরি সামরিক ড্রোন বিক্রি নিয়েও কথা হবে।
এরদোয়ান কি পিছু হটলেন?
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশন্স প্রকাশিত একটি প্রকাশনায় গবেষক স্টিভেন এ কুক লিখেছেন, এরদোয়ান তার ‘স্বভাবসুলভ আগ্রাসী’ পররাষ্ট্রনীতি থেকে হয়তো পিছু হটছেন। অনর্থক আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির কারণে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ধনী উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলেছিলেন তিনি। তাতে তুরস্কের কোনো লাভ হয়নি।
২০১৩ সালে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড সরকার উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করলে প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন এরদোয়ান। তখন থেকেই মিসরের বিরোধী রাজনীতিবিদদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। ইস্তাম্বুলে বসে সিসি সরকারের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাতে দিয়েছেন।
সৌদি আরব মিসরের ওই সামরিক অভ্যুত্থানে সমর্থন দিলে সৌদি রাজপরিবারের ওপরও ক্ষেপে যান তুর্কি প্রেসিডেন্ট। ফলে, ২০১৭ সালে সৌদি আরব, আমিরাতসহ চারটি উপসাগরীয় দেশ কাতারের ওপর অবরোধ আরোপ করলে কাতারীয়দের সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুরস্ক।
এরপর ২০১৮ সালে খাশোগি হত্যাকাণ্ডের পর সৌদি ও আমিরাতকে একহাত নিতে সবধরনের চেষ্টা চালান এরদোয়ান। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, খাশোগি হত্যার বিচারের চেয়ে এরদোয়ানের প্রধান লক্ষ্য ছিল, ওই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে সৌদি আরবকে ঘায়েল করা। ফলে, সৌদি আরব, আমিরাত ও মিসরের মত মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে তুরস্কের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয়।
এই টানাপোড়েনের আগে সৌদিরা ছিল তুরস্কে স্থাবর সম্পত্তির সবচেয়ে বড় ক্রেতা। সৌদি আরবে ব্যবসা করছিল ১০০টিরও বেশি তুর্কি প্রতিষ্ঠান। এক লাখের মতো তুর্কি নাগরিক কাজ করতেন সৌদি আরবে।
সৌদি অর্থনৈতিক বিশ্লেষক আমাল আব্দুল-আজিজ আল-হাজানির দেওয়া তথ্যমতে, তুরস্ক ২০২৩ সালের মধ্যে ২ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের সৌদি বিনিয়োগ টার্গেট করেছিল এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য দুই হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। সেসব লক্ষ্য পুরোপুরি ভেস্তে যায়।
বন্ধু কমছে, শত্রু বাড়ছে
সাদি হামদি বলেন, তুরস্কের ভোটারদের কাছে পররাষ্ট্রনীতির চেয়ে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির গুরুত্ব অনেক বেশি। অনেকের মধ্যে এমন ধারণা জোরালো হচ্ছে যে, এরদোয়ানের কারণে তুরস্কের বন্ধু কমছে ও শত্রু বাড়ছে।
সম্প্রতি তুরস্কের সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ব্যবসায়িক সম্মেলনে এক নারী উদ্যোক্তা দাঁড়িয়ে চিৎকার করে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানকে বলছেন, সৌদি আরবের সঙ্গে বিরোধের কারণে তার ব্যবসা লাটে ওঠার পথে।
শুধু অর্থনীতিই নয়, ভূ-রাজনীতিতেও তুরস্ককে পাল্টা আঘাত করতে তৎপরতা শুরু করেছিল সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। পূর্ব ভূমধ্যসাগরে মজুত জ্বালানির মালিকানা নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে বিরোধে সাইপ্রাস ও গ্রিসকে সমর্থন করে মিসর, সৌদি আরব ও আমিরাত। ২০২০ সালে গ্রিক বিমানবাহিনীর এক মহড়ায় অংশ নেন সৌদি ও আমিরাতের বিমানসেনারা।
এসব ঘটনা তুরস্ককে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। স্টিভেন এ কুক তার বিশ্লেষণে বলেন, এরদোয়ান সরকার উপলব্ধি করছে যে, আরব দেশগুলোর ওপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মতো শক্তি তাদের নেই। আর সেজন্যই দৃশ্যত উল্টো পথে হাঁটতে শুরু করেছেন এরদোয়ান।
যেসব ছাড় দিয়েছে তুরস্ক
সম্প্রতি খাশোগি হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক। মিসরের বেশ কয়েকজন বিরোধী রাজনীতিবিদ ইস্তাম্বুলে বসে প্রেসিডেন্ট সিসির সরকারের বিরুদ্ধে যে তৎপরতা চালাচ্ছিলেন, তা প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের পরিচালিত অনেক টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়ে গেছে। মিসরীয় সরকারবিরোধীদের পরিচালিত বেশ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া সাইটও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের অনেককে তুরস্ক ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তাহলে কি এরদোয়ান তার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে ভুল স্বীকার করছেন? সাদি হামদি মনে করেন, সরাসরি ভুল স্বীকার না করলেও তুর্কি প্রেসিডেন্ট মেনে নিচ্ছেন যে, তিনি যেমনটা চেয়েছিলেন তা হয়নি।
হামদির মতে, নির্বাচনের আগে এরদোয়ান তুরস্কের জনগণকে দেখাতে চান, অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোকে তার সরকার বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে তুর্কি নেতা তার পররাষ্ট্রনীতি বর্জন করছেন বলে মনে করেন না সাদি হামদি। তার বিশ্বাস, বড়জোর স্বল্প মেয়াদে অগ্রাধিকার বদলেছেন এরদোয়ান।
সৌদি আরব কেন সাড়া দিচ্ছে
প্রথম কথা, খাশোগি হত্যাকাণ্ডে ধাক্কা খাওয়া ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে মরিয়া হয়ে উঠেছেন যুবরাজ সালমান। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তাকে খানিকটা হলেও সেই সুযোগ করে দিয়েছেন।
একইসঙ্গে সাদি হামদি মনে করেন, বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটে সস্তায় তুরস্কের সম্পদে অংশীদার বা মালিক হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না সৌদি আরব। তাছাড়া, তুরস্কের সমাজ ও রাজনীতির অন্যান্য অংশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনেরও সুযোগ পেয়েছে সৌদি আরব এবং আমিরাত। মোহাম্মদ বিন সালমান এবং মোহাম্মদ বিন জায়েদ হয়তো মনে করছেন, এরদোয়ান দীর্ঘদিন থাকবেন না, তাই তুরস্কের বিরোধী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের এটাই সেরা সুযোগ।
সূত্র: বিবিসি বাংলা