শিরোনাম
ভারতীয় পুলিশ তাদের হেফাজতে থাকা একদল মুসলিম পুরুষকে বেদম প্রহার করছে, এরকম একটি ভিডিও অনলাইনে দেখেছেন লাখ লাখ মানুষ। ভিডিওটি শেয়ার করেছেন ক্ষমতাসীন বিজেপির এক নির্বাচিত জন-প্রতিনিধি, যিনি পুলিশের নিষ্ঠুর আচরণের প্রশংসা করেন এই বলে যে, এই পিটুনি আসলে এই লোকগুলোর জন্য একটি ‘উপহার’।
এই ঘটনায় জড়িত অফিসারদের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পিটুনির শিকার মানুষগুলোর পরিবার বলছে, তাদের প্রিয়জনরা নির্দোষ, এবং তাদের মুক্তি দেয়া উচিৎ।
‘এটা আমার ভাই, ওকে প্রচণ্ড মেরেছে ওরা, ও ব্যথায় অনেক চিৎকার করছিল,’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন জেবা। যে হাতে ধরা মোবাইল ফোনে তিনি তার ছোট ভাই সাইফকে মারার এই ভয়ংকর ভিডিওটি দেখছিলেন, তার সেই হাতটি কাঁপছিল।
‘এই দৃশ্যের দিকে আমি তাকাতে পারছি না। ওকে যে কি সাংঘাতিকভাবে মেরেছে,’ বলছিলেন তিনি। উত্তর ভারতের শহর সাহারানপুরে নিজের বাড়িতে এসময় তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিলেন আত্মীয়-স্বজনরা। বিচলিত হওয়ার মতো ভিডিওটিতে দেখা যায় কিছু ভারতীয় পুলিশ তাদের হাতে বন্দী কয়েকজন মুসলিম পুরুষকে মারতে উদ্যত, যার মধ্যে জেবার ভাইও রয়েছে।
ভিডিওতে আরও দেখা যায়, পুলিশ অফিসাররা এই লোকগুলোকে রড দিয়ে পেটাচ্ছে, রডগুলো তারা বেসবল ব্যাটের মতো করে ঘোরাচ্ছে। প্রতিবার যখন কারও ওপর এরকম রডের বাড়ি পড়ছে, তখন তার শব্দ শোনা যাচ্ছে, এরপরই শোনা যাচ্ছে চিৎকার।
‘খুব ব্যথা লাগছে, খুব ব্যথা লাগছে ...আর মেরো না,’ আতংকে-ভয়ে এক কোনায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকা কয়েকজনকে বলতে শোনা যায়।
কিন্তু এরপরও যখন বেদম প্রহার চলতে থাকে, তখন সবুজ রঙের টি-শার্ট পরা এক লোককে তার হাত জোড়া করে প্রার্থনা করতে দেখা যায়। আর সাদা শার্ট পরা সাইফকে দেখা যায় উপরে দুই হাত তুলতে, যেন সে আত্মসমর্পণ করছে।
গত সপ্তাহে পুলিশ যে কয়েক ডজন মুসলিম পুরুষকে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছিল, ২৪-বছর বয়সী সাইফ তাদের একজন।
ভারতে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা ইসলামের নবী সম্পর্কে উস্কানিমূলক কিছু মন্তব্য করার পর দেশটিজুড়ে যে প্রতিবাদ শুরু হয়, সাহারানপুরেও শুক্রবার মসজিদে জুমার নামাজের পর সেরকম বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল হাজার হাজার মানুষ।
মুসলিম দেশগুলো থেকে তীব্র প্রতিবাদের মুখে বিজেপি অবশ্য পরে নূপুর শর্মাকে দল থেকে বরখাস্ত করে এবং বলে, তারা যে কোন ধর্মকে অবমাননার বিরুদ্ধে।
সাহারানপুরের এই প্রতিবাদ ছিল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ, মসজিদ থেকে বেরিয়ে লোকজন শহরের দোকানপাটের সামনে দিয়ে মিছিল করে যায়।
তবে উত্তেজনা যখন বাড়ছিল, তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মালিকানাধীন কিছু দোকানে হামলা হয়, এবং দুজন ব্যবসায়ী সামান্য আহত হন। জনতাকে ছত্র-ভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠি চালায়।
পুলিশের কাগজপত্রে অভিযোগ করা হয় যে, সাইফ এবং আরও ৩০ ব্যক্তি মিলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করেছে, সহিংসতায় উস্কানি দিয়েছে, একজন সরকারি কর্মচারীর কাজে বাধা দিতে ইচ্ছেকৃতভাবে তাকে আহত করেছে এবং তাদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে।
সাইফের পরিবার কার্ডবোর্ড বিক্রি করে কোনরকমে জীবন চালায়। তারা বলছে, সাইফ নির্দোষ, এমনকি সে ঐ বিক্ষোভেও পর্যন্ত ছিল না।
তারা জানায়, সাইফ শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকেল পাঁচটার দিকে ঘর থেকে বেরিয়েছিল তার এক বন্ধুর জন্য বাসের টিকেট কাটতে। তখন পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে এবং সাহারানপুরের কোতোয়ালি থানায় নিয়ে যায়।
জেবা যখন তাকে থানায় দেখতে যান, তখন তার ভাইয়ের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন বলে জানান, ‘বেদম পিটুনির ব্যথায় তার শরীর নীল হয়ে গিয়েছিল, ও ঠিকমত বসতে পর্যন্ত পারছিল না।’
এই ভিডিও, যাতে স্পষ্টভাবেই পুলিশের নৃশংসতা দেখা যাচ্ছে, সেটি অনলাইনে শেয়ার করেন বিজেপির এক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, শালাভ ত্রিপাঠি। ভিডিওর নীচে তিনি আবার ক্যাপশনে লিখেছিলেন, ‘বিদ্রোহীদের জন্য একটি পাল্টা উপহার।’ ভিডিওটি অনলাইনে ভাইরাল হয়।
ত্রিপাঠি ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এক রাজনীতিক এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সাবেক মিডিয়া উপদেষ্টা। ঘটনাটি ঘটেছে এই প্রদেশেই।
বিজেপির পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত এই ভিডিওর ঘটনার কোনও নিন্দা করা হয় নি, বিজেপি সরকারের তরফ থেকেও নয়।
মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, ভারতে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে সেখানে পরিবেশ ক্রমেই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। দেশটির সংখ্যালঘু মুসলিমদের টার্গেট করে ঘৃণা-বিদ্বেষপূর্ণ কথাবার্তা বাড়ছে, বাড়ছে তাদের টার্গেট করে হামলার ঘটনা।
বিবিসি এপর্যন্ত আধা ডজন মুসলিম পরিবারের সাক্ষ্য নিয়েছে যারা বলছে, গত শুক্রবার সাহারানপুরে তাদের আত্মীয়-স্বজনকে গ্রেফতারের পর কোতোয়ালি থানায় পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারধর করা হয়েছে।
তারা ভিডিওতে তাদের নিকটজনকে চিহ্নিতও করেছেন, যাতে দেখা যায় পুলিশ সহিংসতা চালাচ্ছে। অন্য ফুটেজে দেখা যায়, এই লোকগুলোকে একটি ভ্যানে তুলে অন্য একটি স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই দৃশ্যে কোতোয়ালি থানার সাইনবোর্ড স্পষ্টভাবেই চোখে পড়ে।
পুলিশের রিপোর্টেও কোতোয়ালি থানার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও এ সপ্তাহের শুরুতে স্থানীয় পুলিশ সেখানে এরকম কিছু ঘটার কথা অস্বীকার করেছিল।
‘সাহারানপুরে এরকম কোন ঘটনা ঘটেইনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় দুটি বা তিনটি ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। আপনি যদি একটি ভিডিও স্লো মোশনে দেখেন- আপনি সেখানে অন্য একটি জেলার নাম দেখতে পাবেন,’ বিবিসিকে বলছিলেন এক সিনিয়র পুলিশ অফিসার আকাশ টোমার।
তবে টোমার পরবর্তীকালে জানিয়েছেন, তিনি এই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করছেন, এবং দরকার হলে ব্যবস্থা নেবেন।
ভিডিওতে অন্য যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের পরিবার জানিয়েছেন, তাদের প্রিয়জনরা যখন আরও তথ্যের জন্য থানায় গিয়েছিলেন, তখন তাদের আটক করা হয়।
কর্মকর্তারা বলছেন, শুক্রবারের বিক্ষোভের সময় সহিংসতার অভিযোগে তারা ৮৪ জনকে গ্রেফতার করেছে।
পুলিশের সুপারিন্টেনডেন্ট রাজেশ কুমার বিবিসিকে বলেন, কেবলমাত্র অপরাধীদেরই গ্রেফতার করা হয়েছে।
‘আমরা যখন কাউকে গ্রেফতার করি, তখন আমরা প্রথমে তারা যে কোন সহিংস বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছিল এমন ফুটেজ তাদের দেখাই, এরপরই কেবল তাদের গ্রেফতার করা হয়,’ বলছেন তিনি।
তবে তার এই কথার সঙ্গে গ্রেফতার হয়েছে এমন কিছু লোকের পরিবারের কাছ থেকে বিবিসি যে বিবরণ শুনেছে, তা মিলছে না।
পুলিশের থানায় যখন এসব ঘটনা ঘটছে, তখন শহরের অন্যদিকে আইনের জোর অন্যভাবে প্রদর্শিত হচ্ছে- বুলডোজার দিয়ে দুজন মুসলিম পুরুষের বাড়ির অর্ধেক অংশ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। এই দুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সহিংসতায় উস্কানি দিয়েছিল।
ভারতে লাখ লাখ মানুষ এমন সব জোড়াতালি দেয়া ঘরবাড়িতে থাকে, যেগুলো কর্তৃপক্ষের যথাযথভাবে অনুমোদিত পরিকল্পনা ছাড়াই নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বিজেপি এখন অহরহ এই বিষয়টিকে শাস্তির একটি কারণ হিসেবে ব্যবহারের কৌশল নিয়েছে।
সাম্প্রতিক বিক্ষোভে অংশ নেয়া লোকজনের অবৈধভাবে নির্মিত ঘর-বাড়ি ভেঙ্গে দেয়ার যে নির্দেশ, তা একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন পেয়েছে।
উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ টুইট করে জানিয়েছেন, কথিত আইন-ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে বুলডোজারের কাজ চলবে। এবং শুক্রবার যে মুসলিমরা নামাজ পড়েন, তাদের প্রতি প্রচ্ছন্নভাবে ইঙ্গিত করে তার মিডিয়া উপদেষ্টা মৃত্যুঞ্জয় কুমার একটি বুলডোজারের ছবি পোস্ট করেন। এর নীচে লেখা, ‘শুক্রবারের পর শনিবার আছে কিন্তু!’
কর্মকর্তারা বলছেন, যাদেরকে ধরা হয়েছে, তাদের পরিবারকে এরকম নোটিশ দেয়া হয়েছিল যে, তাদের বাড়ি-ঘর যথাযথ অনুমোদন ছাড়া তৈরি করা হয়েছে।
‘আমরা যখন তদন্ত চালাই, তখন দেখলাম তার পরিবার এমন এক আত্মীয় বাড়িতে থাকছে, যেটি অনুমোদন ছাড়া নির্মাণ করা,’ বিবিসিকে বলছিলেন একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার রাজেশ কুমার।
‘পৌর কর্তৃপক্ষ কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় এসব বাড়ি পরিদর্শন করেছে এবং এরপর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে,’ বলছেন রাজেশ কুমার। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, গ্রেফতার হওয়া আরও লোকজনের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভাঙ্গা হবে।
‘যাদের গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হয়েছে, তাদের ব্যাপারে অবৈধ কোন কিছু জানা গেলে বুলডোজার চালানো হবে,’ বলছেন তিনি।
যোগী আদিত্যনাথের একজন উপদেষ্টা নভনীত সেহগাল বলেন, বুলডোজার দিয়ে যা করা হচ্ছে তা আইন মেনেই এবং ‘সব নিয়মে মেনেই করা হচ্ছে ... এখানে আইনের বিরুদ্ধে কিছু হচ্ছে না।’
কিন্তু ভারতের একদল শীর্ষস্থানীয় আইন বিশেষজ্ঞ, যাদের মধ্যে সাবেক বিচারপতি এবং নামকরা আইনজীবীরা রয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন পেশ করেছেন পুলিশের এসব মারধর এবং বুলডোজারের অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহারের সর্বশেষ ঘটনাবলীর বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে।
তাদের চিঠিতে তারা অভিযোগ তুলেছেন, আদিত্যনাথ পুলিশকে ‘নিষ্ঠুর এবং বেআইনিভাবে বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্যাতন চালাতে’ মদত দিচ্ছেন। তারা আরও বলেছেন, ‘সর্বশেষ এসব ঘটনা জাতির বিবেককে নাড়া দিচ্ছে।’
‘শাসকশ্রেণীর এরকম নিষ্ঠুর দমন-নিপীড়ন আইনের শাসনকে যেভাবে ধ্বংস করছে, তা মানা যায় না। এটি সংবিধান এবং রাষ্ট্র যেসব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে, তাকে একটা পরিহাসে পরিণত করেছে,’ বলছেন তারা।
মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও ভারত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে যে, তারা যে কোন ধরণের ভিন্নমতকে দমন করতে চাইছে।
‘ভারত সরকার বেছে বেছে এবং হিংস্রভাবে সেই সব মুসলিমের ওপরই দমন চালাচ্ছে, যারা তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছে এবং শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ভিন্নমত তুলে ধরছে।’
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারতীয় বোর্ডের প্রধান আকার প্যাটেল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বিক্ষোভকারীদের মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে দমন করা, বিনা বিচারে আটকে রাখা এবং শাস্তি হিসেবে ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দেয়া - এগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং মানদণ্ড রক্ষা করে চলার যে অঙ্গীকার ভারত করেছে, তার পুরোপুরি লঙ্ঘন।’
সূত্র: দেশ রূপান্তর