শিরোনাম
দুর্ঘটনা পরিস্থিতিতে উদ্ধারকারীদের অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। চোখের সামনে মর্মান্তিক ঘটনা দেখলেও অশ্রু আটকে রাখতে হয়। বুক ফেটে যায়, কিন্তু মুখে টু শব্দ নেই। উদ্ধারকারীকে তো নরম হলে চলবে না, তাকে হতে হবে ইস্পাতের মতো শক্ত। এ জন্যই ৮০ ফুট গভীরে পড়া বাচ্চাটির করুণ দশা দেখেও কাঁদতে পারেননি অনিল কুমার। বরং তাকে জাগিয়ে রাখতে বুকে ভর দিয়ে উপুড় হয়ে টানা ১১৭ ঘণ্টা কথা বলে গেছেন ভারতের জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর (এনডিআরএফ) এ সদস্য।
সম্প্রতি ছত্তিশগড়ের জাঞ্জগীর-চাম্পা জেলার পিহরিদ গ্রামে নিজ বাড়ির পেছনে একটি পরিত্যক্ত কুয়ার ভেতর পড়ে যায় শিশু রাহুল। তারপর থেকেই তাকে উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করে এনডিআরএফ, রাজ্য বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীসহ (এসডিআরএফ) পুলিশের উদ্ধারকারী দল।
উদ্ধারকাজ চলাকালে একটি পাইপের মাধ্যমে শিশুটির কাছে শুকনো খাবার ও অক্সিজেন পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। নেওয়া হয় বিশেষ রোবট। তবু রাহুলকে উদ্ধারে প্রায় পাঁচদিন লেগে যায় উদ্ধারকারীদের।
এই দীর্ঘ সময় তাকে বাঁচিয়ে রাখতে যারা প্রাণান্ত চেষ্টা চালান, তাদেরই একজন এনডিআরএফ সদস্য বি অনিল কুমার। ‘রাহুল ওঠো… রাহুল জেগে আছো?... রাহুল, তোমার জন্য কলা এনেছি…’ প্রায় পাঁচদিন কুয়ার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে এমন অনেক কথাই বলে গেছেন অনিল।
১১ বছর বয়সী শিশুটি কানে শোনে না, কথাও বলতে পারে না। ফলে তার কাছে এই বার্তা পৌঁছানো কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিল, তা স্মরণ করতে করতেই বিষণ্ণ হয়ে পড়েন অনিল। তিনি বলেন, রাহুলকে অনবরত ডেকে গেছি। গলার আওয়াজের যে কম্পন, সেটি তার কাছে পৌঁছাচ্ছিল। ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় আমার সেই ডাকে সাড়াও দিচ্ছিল শিশুটি।
রাহুলের অবস্থান জানতে দড়ির সাহায্যে কুয়ার ভেতরে ক্যামেরা পাঠানো হয়। অনিল বলেন, সেই ক্যামেরার মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করছিলাম, রাহুল ঠিক কী অবস্থায় রয়েছে। প্রথমে মনে একটা শঙ্কা তৈরি হয়েছিল যে, ছেলেটি বেঁচে রয়েছে তো? কিন্তু ক্যামেরায় ওর নড়াচড়া দেখে মনে জোর পাই। নিজেকে বারবার বলছিলাম, বাচ্চাটিকে বাঁচাতেই হবে।
অনিল বলেন, শিশুটির অবস্থা দেখে কান্না পেলেও কাঁদতে পারিনি। কারণ ভেঙেপড়া আমাদের কাজ নয়। যে করেই হোক প্রাণ বাঁচাতে হবে। তাই যতবারই রাহুল আমার ডাকে সাড়া দিয়েছে, গলা বুজে এলেও কাঁদতে পারিনি।
টানা পাঁচদিন কুয়ার ৮০ ফুট গভীরে আটকে থাকা রাহুলের শারীরিক অবস্থার ওপর নজর রাখছিলেন অনিল কুমার। শিশুটির শ্বাসপ্রশ্বাস চলছিল কি না, কুয়ায় পাঠানো যন্ত্রের সাহায্যে শুনতে পাচ্ছিলেন। তার কথায়, রাহুলকে উদ্ধারের জন্য যখন ড্রিল মেশিন দিয়ে বড় বড় পাথর কাটা হচ্ছিল, তখন তার হৃদ্স্পন্দন বেড়ে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত চলছিল। তাই চিৎকার করে সেই ড্রিল বন্ধ করতে বলি। কারণ ভয়ে ছেলেটির যেকোনো সময় হার্টফেল হতে পারতো।
অনিল বলেন, রাহুলের নাম ধরে ডাকা শুরু করেছিলাম। তাকে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করে গেছি অনবরত। তার ভরসা ও বিশ্বাস জুগিয়েছি প্রথমে। ছেলেটি কাঁদছিল। ওর কাছে কলা ও এক প্যাকেট ফলের রস পাঠিয়েছিলাম। ওগুলো সে খেয়েছিল। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, রাহুল কীভাবে ডাকে সাড়া দিল। ছেলেটি কানে শোনে না, কথাও বলতে পারে না। এই ঘটনাটিকে ‘আশ্চর্যজনক’ বলে দাবি করেন উদ্ধারকারী দলের এই সদস্য।
তিনি বলেন, রাহুলকে দেড় ঘণ্টার বেশি ঘুমাতে দেইনি। আমার লক্ষ্য ছিল, যেভাবেই হোক ওকে জাগিয়ে রাখতে হবে। একসময় রাহুলের গলা পর্যন্ত পানি উঠে গিয়েছিল। তখন ঈশ্বরকে ডাকছিলাম, আর কিছুটা সময় দাও যাতে ছেলেটিকে বাঁচাতে পারি।
অনিল জানান, তার শিরদাঁড়া দিয়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে গিয়েছিল যখন দেখতে পান, গর্তে রাহুল একা নেই, সঙ্গে একটি সাপও রয়েছে। তার কথায়, সাপটি বিষধর কি না তা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। যখন বুঝতে পারলাম সেটি বিষধর নয়, কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা