শিরোনাম
সুমাইয়া ফাতিমার বয়স ১৯ বছর। বাড়ি ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজে (এলাহাবাদ)। সুমাইয়ারা চার ভাই-বোন। মা-বাবা আর ভাই-বোনসহ সেখানে দোতলা একটি বাড়িতে সুখেই ছিল সুমাইয়াদের পরিবার। কিন্তু গত রোববার হঠাৎ করে পরিবারটির ওপর চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। ওই দিন সরকারি বুলডোজার এসে ভেঙে দেয় তাঁদের সুখের আবাস।
পরিবারটির ‘অপরাধ’, তারা মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা-নেত্রীর অবমাননাকর মন্তব্যের প্রতিবাদে আয়োজিত প্রতিবাদ-বিক্ষোভে যুক্ত ছিল। এ কারণে সুমাইয়াদের বাড়িকে ‘অবৈধ স্থাপনা’ হিসেবে চিহ্নিত করে তা গুঁড়িয়ে দেয় উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সরকার।
আবাস হারিয়ে সুমাইয়া বলেন, ‘এটা ছিল এমন একটি জায়গা, যেখানে আমি মুক্ত ও নিরাপদ বোধ করতাম। বাড়িটির প্রতিটি ইট, কাঠ, পাথরে আমার ও পরিবারের বাকি সদস্যদের অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে ছিল।’
২০১৪ সালে ভারতে ক্ষমতায় আসে বিজেপি সরকার। আর ২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশে বিজেপি-সমর্থিত সরকার গড়েন যোগী আদিত্যনাথ। বিজেপির আমলে ভারতজুড়ে সংখ্যালঘু, বিশেষত মুসলমানদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। যার সর্বশেষ নজির রাজ্য সরকারের নির্দেশে বুলডোজার দিয়ে সুমাইয়াদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা।
সুমাইয়া জানান, বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি তাঁদের আগে থেকে জানানো হয়নি। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাড়ি থেকে বের করে আনার সুযোগ পাননি তাঁরা। সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা কিছুই বাঁচাতে পারিনি। চোখের সামনে বাড়িটা পুরোপুরি স্মৃতি হয়ে গেল। আমি এমন অসহায় আগে কখনোই বোধ করিনি।’
বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগে সুমাইয়ার বাবা জাভেদ মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তিনি স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। জাভেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা মহানবী (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ আয়োজনে যুক্ত ছিলেন। পরে মুসলিমদের ওই বিক্ষোভের জেরে রাজ্যে সহিংসতা ছড়ায়।
এর আগে গত মে মাসে টেলিভিশনে এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেন নূপুর শর্মা। তিনি তখন বিজেপির মুখপাত্র ছিলেন। দেশ-বিদেশে নিন্দার ঝড় উঠলে দল থেকে সাময়িকভাবে তাঁকে বরখাস্ত করে বিজেপি।
নূপুর শর্মার ওই মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হন ভারতের মুসলিমরা। এ ঘটনায় বিজেপির দিল্লি মিডিয়া ইউনিটের প্রধান নবীন কুমার জিন্দালকেও বহিষ্কার করা হয়। নূপুর শর্মার আপত্তিকর মন্তব্যের একটি স্ক্রিনশট টুইট করার কারণে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করে বিজেপি।
বিজেপির এই দুই নেতা, বিশেষ করে নূপুর শর্মার মন্তব্যের প্রতিবাদ ও তাঁকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবিতে বেশ কয়েকটি রাজ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়। এরপর উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ অবৈধ স্থাপনা এবং বিক্ষোভে সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্তদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন বলে জানিয়েছেন রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র।
শুধু জাভেদ মোহাম্মদ নন, বিক্ষোভ-প্রতিবাদে অংশ নেওয়ার দায়ে উত্তর প্রদেশে তিন শতাধিক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সুমাইয়ার বোন ও জাভেদ মোহাম্মদের আরেক মেয়ে আফরিন ফাতিমা মুসলিম অধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিত। ভারতে বিতর্কিত নাগরিক আইন ও স্কুলে মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিজাব পরার অধিকার কেড়ে নেওয়া নিয়ে বিতর্কের সময় আন্দোলন করেছেন আফরিন।
সপ্তাহজুড়ে সুমাইয়া-আফরিনদের বাড়িসহ আরও কয়েকটি মুসলিম বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে উত্তর প্রদেশ সরকার। এ জন্য আদিত্যনাথ, তথা বিজেপি সরকারের উগ্র হিন্দুত্ববাদী আচরণকে দায়ী করছেন বিরোধীরা। এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অসীম আলী বিবিসিকে বলেন, বাড়ি মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতীক। অনেকের একটি বাড়ি বানাতে পুরো জীবন লেগে যায়। তাই বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া ভীষণ নৃশংস ঘটনা।
অসীম আলী আরও বলেন, বুলডোজার দিয়ে বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মুসলিমদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে রাষ্ট্র চাইলে সংবিধান অমান্য করে হলেও তাঁদের শাস্তি দিতে পারে। বিচার বিভাগ ও সংবিধান তাঁদের রক্ষায় যথেষ্ট নয়।
জাভেদ মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ-সহিংসতার মাধ্যমে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ এনেছে পুলিশ। একই ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর মেয়ে আফরিনের বিরুদ্ধেও। পুলিশের দাবি, বাবা-মেয়ে মিলে ষড়যন্ত্র করেছেন, গুজব ছড়িয়েছেন, প্রচার চালিয়েছেন। যদিও আফরিনকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি। বাবা ও বোনের বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সুমাইয়া ও তাঁর ভাই মোহাম্মদ উমাম।
সুমাইয়া বলেন, ‘আব্বা ভীষণ স্পষ্টবাদী। তবে সবাইকে সহায়তা করতে পছন্দ করেন। সবার সঙ্গে তাঁর ভালো সম্পর্ক রয়েছে। প্রতিবেশী, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ, এমনকি অচেনা মানুষও তাঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলতে পারেন। আমি তাঁর মেয়ে হিসেবে গর্বিত।’ তিনি জানান, বাড়িতে তাঁরা বাবা আর বোনকে নিয়ে মজা করতেন। বলতেন, স্পষ্টবাদী আচরণের জন্য তাঁদের একদিন ভুগতে হবে। তবে সেটা যে এভাবে হবে, তা আগে বুঝতে পারেননি পরিবারের কেউই।
প্রয়াগরাজ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, জাভেদ মোহাম্মদের বাড়ি অবৈধ স্থাপনা হিসেবে আগেই চিহ্নিত করা হয়েছিল। এ জন্য গত ১০ মে তাঁকে নোটিশ দেয় কর্তৃপক্ষ। ২৪ মের আগে অবৈধ স্থাপনা থেকে সরে যেতে বলা হয়েছিল তাঁকে।
তবে এমন কোন নোটিশ পাওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন জাভেদের ছেলে মোহাম্মদ উমাম। তিনি বলেন, ‘বাড়ির জমিটা আমার মায়ের নামে। আমার নানার কাছ থেকে সেটা উপহার পেয়েছিলেন মা। বিদ্যুৎ ও পানির বিল, কর মায়ের নামেই পরিশোধ করা হয়। কিন্তু এখন কর্তৃপক্ষ বলছে, উচ্ছেদের নোটিশ আমার বাবার নামে ইস্যু করা হয়েছে, এটা কীভাবে সম্ভব?’
এ বিষয়ে জানতে বিবিসির পক্ষ থেকে প্রয়াগরাজ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অন্তত দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তাঁরা বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন।
সুমাইয়াদের হঠাৎ করে উচ্ছেদ করা ও বুলডোজার দিয়ে বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাকে ‘অত্যন্ত অন্যায়’ বলে মন্তব্য করেছেন এলাহাবাদ হাইকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি গোবিন্দ মাথুর। বিবিসিকে তিনি বলেন, যদি ওই ব্যক্তি (জাভেদ মোহাম্মদ) বাড়ি বানাতে গিয়ে নকশা-বহির্ভূত কোনো স্থাপনা নির্মাণ করে থাকেন, তাহলে কর্তৃপক্ষ ওই ব্যক্তিকে জরিমানা করতে পারত। রাজ্যের পৌর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারত। পরিবারটিকে নিজস্ব অবস্থান সুস্পষ্ট করার জন্য সময় দেওয়া দরকার ছিল। হঠাৎ করে পরিবারসমেত উচ্ছেদ করাটা অন্যায় হয়েছে।
পুরো ঘটনা বিশ্লেষণ করে অসীম আলী বলেন, মুসলিমদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করতেই জাভেদ মোহাম্মদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে উত্তর প্রদেশ সরকার। পরিবারসহ তাঁদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রাজ্য সরকার মুসলিমদের অধিকার সংগঠনগুলোকে সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছে, নিজেদের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার নিয়ে চাপ প্রয়োগ বন্ধ করুন।
বাস্তবেও অনেকটা এমন চিত্র দেখা গেছে। প্রয়াগরাজের যেখানে সুমাইয়াদের বাড়ি ছিল, ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে সুনসান নীরবতা বজায় রয়েছে। প্রতিবেশীদের কেউ এই বিষয়ে সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে নারাজ। সেখানকার অনেকের মতে, কথা বললে তাঁদের ওপরও প্রতিশোধের খড়্গ নেমে আসতে পারে। তাঁদেরও উচ্ছেদ করা হতে পারে।
সুমাইয়াদের একজন প্রতিবেশী নাম গোপন রাখার শর্তে বিবিসিকে বলেন, শহরজুড়ে হাজারো বেআইনি ভবন রয়েছে। কিন্তু এখন মুসলিম মালিকানায় থাকা ভবনগুলোয় বেছে বেছে অভিযান চলছে। গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে সুমাইয়ার ভাই মোহাম্মদ উমাম বলেন, ‘গত ঈদের সময়ও বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। এখন বাড়িটির অস্তিত্ব নেই। সরকারি লোকেরা শুধু একটি বাড়ি গুঁড়িয়ে দেননি। আমাদের পুরো পরিবার ও আমাদের পুরো পরিবারের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়েছেন।’
এত কিছুর পরও বুলডোজারের ব্যবহার চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছে উত্তর প্রদেশ সরকার। রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী ব্রজেশ পাঠক সতর্ক করে বলেন, উন্নয়নকাজে বাধাদানকারী ব্যক্তিদের জন্য উত্তর প্রদেশে কোনো জায়গা নেই এবং সমস্যা সৃষ্টিকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বুলডোজারের ব্যবহার অব্যাহত থাকবে।
অনুবাদ-প্রথম আলো