শিরোনাম
সাপের প্যাচের মতো শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কষ্ট-ভোগান্তি তো রয়েছেই চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জীবন নিয়ে শঙ্কার মধ্যে দিন কাটছে দুই কোটি ২০ লাখ মানুষের। দেশটির সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে গৃহযুদ্ধে জয়লাভের জন্য অনেকের কাছে বীর হিসেবে সমাদৃত, অথচ এখন ভিলেনের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন।
ক্ষমতার চেয়ার বদলে কি পরিবর্তন ঘটবে শ্রীলঙ্কার মানুষের ভাগ্যের। নাকি নতুন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের হাত ধরে ক্ষমতা আরও পাকাপোক্ত হবে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের? কেন এমন বিপর্যয় এবং পরবর্তীতে কি ঘটতে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কায় তা নিয়ে চলছে আলোচনা।
চলতি বছর এপ্রিলের শুরু থেকে বিক্ষোভকারীরা দেশকে অর্থনৈতিক ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে এবং তার ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছিল। কিন্তু এই সপ্তাহে চরম সহিংসতায় রুপ নেয় সেই আন্দোলন।
মাহিন্দা রাজাপাকসে গত সোমবার পদত্যাগ করার পর তার সমর্থকরা সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়। প্রতিবাদে রাজধানী কলম্বোসহ দেশজুড়ে শুরু হয় সহিংসতা। রাজাপাকসেদের মালিকানাধীন বেশ কয়েকটি বাড়িসহ রাজনীতিবিদদের কয়েক ডজন বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করেন বিক্ষেভকারীরা। সহিংসতায় নিহত হন আটজন। আহত হন আরও দুইশজন। দেশজুড়ে জারি করা হয় কারফিউ।
বিক্ষোভ চলাকালে অবরুদ্ধ ৭৬ বছর বয়সী মাহিন্দা রাজাপাকসেকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার করে দেশটির সেনাবাহিনী। নিরাপত্তার জন্য দেশটির উত্তর-পূর্বে একটি নৌ ঘাঁটিতে আছেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। সর্বশেষ আদালত দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন দুইবার প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় থাকা মাহিন্দা রাজাপাকসেকে।
অভিযোগ উঠছে, তার ভাই ৭২ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে মাহিন্দা সরকারের ওপর চাপ কমাতে তেমন কিছুই করেননি। বরং মাহিন্দা রাজাপাকসে পদত্যাগ করার পর তিনি নতুন মন্ত্রী হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহেকে নিয়োগ দিয়েছেন।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার পর শ্রীলঙ্কাকে এবারই চরম অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর বড় কারণ বৈদেশিক মুদ্রার অভাব। এই আর্থিক বিপর্যয় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারকারী একটি পরিবারের জন্য নাটকীয় পতন ঘটিয়েছে।
পূর্বসূরিরা ব্যর্থ হলেও শ্রীলঙ্কার তামিল টাইগার বিদ্রোহীদের (এলটিটিই) সঙ্গে প্রায় ৩০ বছর ধরে চলা রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শ্রীলঙ্কার মানুষের কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। ২০০৯ সালে প্রথমবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি তাদের পরাজিত করেন। যুদ্ধের পরপরই বিজয় কুচকাওয়াজ ও জনসাধারণের এক অনুষ্ঠানে তাকে সিংহল বৌদ্ধ রাজাদের সাথেও তুলনা করা হয়। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা-পরবর্তী শ্রীলঙ্কায় সবচেয়ে জনপ্রিয় সিংহল বৌদ্ধ নেতা।
প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক কুশল পেরেরা বলেন, এমনকি কেউ কেউ তাকে সম্রাট মাহিন্দা বলেও প্রশংসা করেন। মাহিন্দা রাজাপাকসেকে নিয়ে ২০১৭ সালে তার লেখা বই ‘রাজাপাকসে: সিংহালা সেলফিতে’ দ্বীপরাষ্ট্রটির রাজনীতিতে রাজাপাকসে পরিবারের ভূমিকা ও কিভাবে মাহিন্দা ক্ষমতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন তা তুলে ধরেছেন।
মাহিন্দা একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। ১৯৭০ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি পার্লামেন্টে যান ও সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হন। মাহিন্দা শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গার অধীনে শ্রমমন্ত্রী এবং মৎস্য ও জলজসম্পদ মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ২০০৪ সালের এপ্রিলে সাধারণ নির্বাচনের পর মাহিন্দাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এরপর থেকেই ক্ষমতার আসন পাকাপোক্ত করেন মাহিন্দা। ২০০৫ সালে মাহিন্দা শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টির প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনে জয়ের পরপরই তিনি লিবারেশন টাইগারস অব তামিল ইলমকে (এলটিটিই) ধ্বংসের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মাহিন্দা তার অবস্থানকে আরও সুসংহত করেছেন। সংবিধান পরিবর্তন করে তাকে তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেওয়া হয়। তার তিন ভাই গোতাবায়া, বাসিল ও চামালকে প্রভাবশালী পদে বসানো হয়।
মাহিন্দাই রাজাপাকসে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এতদিন তার সব ভাই একত্রে কাজ করে আসলেও দেশের অর্থনীতিতে যখন টালমাটাল অবস্থা তখন দেখা দেয় ভাঙনের সুর। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেকে পদত্যাগ করার অনুরোধ জানান। আর এই পদত্যাগের মধ্য দিয়ে হয়ত তার রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটলো।
যদিও তার ছেলে নামাল, রাজাপাকসের ভাইদের মধ্যে দ্বন্দের বিষয়টি অস্বীকার করেন। তবে অবশ্যই দুই ভাইয়ের রাজনৈতিক কৌশলে পার্থক্য রয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি দাবি করেন, তার বাবা মাহিন্দা রাজাপাকসে সব সময় দেশের সাধারণ কৃষক ও আমজনতার সঙ্গে ছিলেন।
সূত্র: বিবিসি, আল-জাজিরা