পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে তুরস্কের শেষ সুযোগ যুদ্ধ

ফানাম নিউজ
  ১০ মে ২০২২, ১২:৪০

গত সপ্তাহে মস্কো সফরের আগে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে দেখা করেন। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে সৃষ্ট সংকট নিরসনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য তুর্কি নেতার প্রশংসা করেন গুতেরেস।

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বিভিন্ন কূটনীতিকদের বরাত দিয়ে জানানো হয়, জাতিসংঘ মহাসচিব ও এরদোয়ান যখন করমর্দন করছিলেন, তখন যুদ্ধ নিরসনে আঙ্কারার ভূমিকা নিয়ে পশ্চিমা দেশের প্রত্যাশা জোরদার হয়। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আঙ্কারা অনবদ্য ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছে পশ্চিমা বিশ্ব। ইউক্রেন সংকটকে কেন্দ্র করে আঙ্কারার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের সম্পর্ক উন্নত হতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।

পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের তিক্ততা বাড়ে অধিকারকর্মী ওসমান কাভালাকে কেন্দ্র করে। এপ্রিলে ইস্তাম্বুলের একটি আদালত কাভালাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। ২০১৩ সালে সরকার উৎখাতের চেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার ঘটনায় তাঁকে এই সাজা দেওয়া হয়। পশ্চিমা বিশ্ব বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ওসমানকে মুক্তি দিতে আহ্বান জানানোর পরও তুরস্ক বিষয়টি উপেক্ষা করেছে। অনেকে এ ঘটনাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ভাবছেন।

আট কূটনীতিবিদ রয়টার্সকে বলেন, পশ্চিমা দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কে কাভালাকে দেওয়া আদালতের ওই রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

তবে ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তুরস্কের সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের নতুন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সুযোগ তৈরি হয়েছে। তুরস্ক রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে। আঙ্কারা চায়, যুদ্ধ নিরসনে পশ্চিমা বিশ্ব প্রস্তুতি নিক। এ জন্য তুরস্কের প্রতিরক্ষা খাতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়েছে দেশটি। যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালিসহ ন্যাটোর মিত্রদেশগুলোর মধ্যে আরও বেশি সহযোগিতা চায় তুরস্ক।

বেশ কয়েকজন কূটনীতিক বলছেন, ২০২৩ সালের নির্বাচনে এরদোয়ান পরাজিত হতে পারেন, এমন আশঙ্কা রয়েছে। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে তিনি খুব বেশি সাফল্য অর্জন করতে পারেননি।

তবে এরদোয়ান ও তুরস্কের কর্মকর্তারা মনে করছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পশ্চিমা দেশগুলো তুরস্কের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে। সম্প্রতি এরদোয়ানের মুখপাত্র ও পররাষ্ট্রনীতি-বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা ইব্রাহিম কালিন হঠাৎ কিয়েভ সফর করেন। তিনি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে দেখা করার উদ্যোগ নেন। পরে ইব্রাহিম কালিন বলেন, তিনি যুদ্ধ নিরসনে জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

কূটনীতিকেরা বলছেন, যদি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা গ্রীষ্মের শেষ পর্যন্ত চলে, তাহলে ইউক্রেনে সমর্থন বাড়ানোর জন্য তুরস্ক পশ্চিমাদের চাপের মুখে পড়বে। তুরস্ক এর মধ্যে কিয়েভে সশস্ত্র ড্রোন পাঠিয়েছে। কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার কিছু নৌপথ বন্ধ করেছে। সিরিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার বিমান চলাচলে বাধা দিয়েছে।

আরেক কূটনীতিক বলেছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতার জন্য তুরস্কের অবস্থান এবং মস্কোর ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তুরস্কের অবস্থান খুব বেশি দিন থাকবে না।

ওই কূটনীতিক আরও বলছেন, পশ্চিমাদের চাপে পড়ে ইউক্রেনের দিকে ঝুঁকলে রাশিয়া তুরস্কের ওপর অর্থনৈতিক চাপ তৈরি করতে পারে। পর্যটক, তেলের প্রবাহ—এসব দিক দিয়ে তুরস্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে রাশিয়া।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় তুরস্কে মুদ্রাসংকট ও মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এসব কারণে এরদোয়ান ২০২৩ সালের নির্বাচনে জয়-পরাজয় নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, অধিকারকর্মী কাভালাকে আদালত যে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছিলেন, তাতে এরদোয়ান প্রভাব খাটিয়েছিলেন। ওয়াশিংটনভিত্তিক মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের গবেষক বিরল বাসকান বলেন, এরদোয়ান চান, পশ্চিমা বিশ্ব তাঁকে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে মেনে নিক।

দুই দশক ধরে তুরস্কের ক্ষমতায় রয়েছেন এরদোয়ান। পশ্চিমা নেতারা তুরস্কের মানবাধিকার ও ভিন্নমত দমন নিয়ে সমালোচনা করেন। কাভালার রায়কে কেন্দ্র করে বার্লিনে নিযুক্ত তুর্কি রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে জার্মানি। এর জবাবে জার্মান রাষ্ট্রদূতকে তলব করে আঙ্কারা। ওয়াশিংটন এ ধরনের আচরণকে অবিবেচনাপ্রসূত বলে সমালোচনা করে।

তবে সে সময় তুরস্ক বলেছে, তাদের আদালত স্বাধীন। কাভেলার রায়কে কেন্দ্র করে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনায় কর্ণপাত করেনি তুরস্ক।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তুরস্ক মস্কো থেকে আসা ফ্লাইটের অনুমোদন দিয়েছে। তহবিল বরাদ্দ ও বাণিজ্যিক সম্পর্কও বজায় রেখেছে। তিন পশ্চিমা কূটনীতিক বলছেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মস্কোর সঙ্গে তুরস্কের এসব বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।

তবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো সঠিক সময়ে যুদ্ধের অবসান চায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন গত সপ্তাহে বলেছেন, ওয়াশিংটন মস্কোকে দুর্বল প্রমাণ করতে চায়। পশ্চিমা বিশ্ব যুদ্ধে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুরস্কের সাফল্য চায়। আর এ কারণে পশ্চিমাদের আশা, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি তুরস্ক পুনর্বিবেচনা করবে।