শিরোনাম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন কোনো বছর নেই, যে বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর কোথাও না কোথাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুদ্ধে জড়ায়নি। কোরিয়ান যুদ্ধ দিয়ে শুরু; তারপর ভিয়েতনাম, সোমালিয়া, ইরান, ইরাক, লিবিয়া এবং সর্বশেষ আফগানিস্তান যুদ্ধ এর অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যে করপোরেট বাণিজ্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত, যুদ্ধবাণিজ্য হলো তার অন্যতম।
যুক্তরাষ্ট্রের এরূপ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মূল উদ্দেশ্যই হলো সেদেশের করপোরেট বাণিজ্যের মুনাফা লাভের পথ তৈরি করে দেওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের এ যুদ্ধবাণিজ্যের শুরুও কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়েই।
এর একটি ঐতিহাসিক পটভূমিও আছে। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর পার্ল হারবারে অবস্থিত মার্কিন নৌঘাঁটিতে জাপানের ধ্বংসাত্মক বিমান হামলার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে নিজস্ব প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও মিত্র দেশগুলোর সামরিক সরঞ্জামের তখন চাহিদা বেড়ে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সামরিক সরঞ্জামের জোগান দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে তখন যে হারে প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে উঠেছিল, তাতে সেদেশে ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলিউশন ঘটে যায়।
উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুতেই অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্রদেশ ব্রিটেন ও ফ্রান্স বিপুলসংখ্যক যুদ্ধবিমান সরবরাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুরোধ করে।
তাদের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট দুই বছরের মধ্যে ৩,০০০ যুদ্ধবিমান তৈরির পরিবর্তে ১ লাখ ৮৫ হাজার যুদ্ধবিমান, ১ লাখ ২০ হাজার ট্যাঙ্ক, ৫৫ হাজার বিমান বিধ্বংসী বন্দুক, ১৮ মিলিয়ন টন মার্চেন্ট শিপিংয়ের হুকুম দেন। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাণিজ্য তখন থেকেই শুরু, যা আজও চলমান। তারপর থেকে এ বাণিজ্য ধরে রাখার জন্য যা যা করণীয় তার সবই তারা করে চলেছে।
কাউকে তোয়াক্কা না করে কিংবা জাতিসংঘকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অন্য দেশে রাজনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ করা যুক্তরাষ্ট্রের একরকম অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এসব করতে গিয়ে পরাজয়ের গ্লানিও কম পোহাতে হয়নি তাদের। ভিয়েতনাম ও সোমালিয়া থেকে কোনোরকমে সৈন্য প্রত্যাহার করে জীবন রক্ষা করা গেলেও ইজ্জত যে রক্ষা করা যায়নি, তা বোধহয় বলার প্রয়োজন নেই। ২০ বছর আফগানিস্তানে অনৈতিক যুদ্ধ ও দখলদারিত্ব চালিয়ে সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে আরও একটি নতিস্বীকারের অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলেই সৈন্য প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু হলেও যেভাবে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য তুলে আনা হলো, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞই তাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
গত ২১ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রথম পাতায় ডেনিয়েল প্লেটকারের ‘Having Won, We Choose to Lose’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধে ডেনিয়েল কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে তার মতপ্রকাশ করেছেন এভাবে-“আমরা আমেরিকানরা নিজেরা নিজেদের ধোঁকা দিতে পছন্দ করি। আমরা বিশ্বাস করি দুনিয়ায় দুই ধরনের যুদ্ধ আছে। তা হলো ‘ভালো যুদ্ধ’ এবং ‘খারাপ যুদ্ধ’। যেমন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ছিল ভালো যুদ্ধ। কারণ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ছিল মার্কিন ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল ‘খারাপ যুদ্ধ’। অথচ ভিয়েতনামের লজ্জাজনক পরাজয় ও তিক্ত অভিজ্ঞতার বাস্তবতাকে আমরা বরাবরই অগ্রাহ্য করে এসেছি।” ১৯৯৩-৯৪ সালে সোমালিয়ায় প্রচণ্ড গোলাগুলির মুখে ‘লেজ গুটিয়ে’ মার্কিন সেনাবাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাহার ছিল আরও একটি ‘খারাপ যুদ্ধে’র উদাহরণ।
ডেনিয়েল আরও লিখেছেন, “৯/১১-এর ঘটনার পর জাতিসংঘকে তোয়াক্কা না করে অপ্রয়োজনীয় অথচ যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব পছন্দের চাপিয়ে দেওয়া ‘আফগান অভিযান’ ছিল ‘ভালো যুদ্ধ’। অপরদিকে গোটা ইরাক দখল করে নিলেও মার্কিনিদের কাছে তা ছিল ‘খারাপ যুদ্ধ’। দীর্ঘ ২০ বছর পর আফগানিস্তান থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর ইরাক ও আফগানিস্তান উভয় যুদ্ধই এখন ‘খারাপ যুদ্ধে’ পরিণত হয়েছে।” ডেনিয়েলের বক্তব্যের সূত্র ধরে বলা যায়, যে কোনো যুদ্ধে বিজয়ী পক্ষের জন্য সে যুদ্ধ বরাবরই ‘ভালো যুদ্ধ’ হিসাবে বিবেচিত হয়।
ডেনিয়েল তার লেখায় ভালো আর খারাপ যুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ নেতাদেরই খোঁচা দিয়েছেন। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ৯/১১-এর টুইন টাওয়ার হামলায় আনুমানিক তিন হাজার মানুষের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শুধু মার্কিন জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্যই আফগানিস্তান ও ইরাকে ভয়ংকর বোমাবর্ষণ করে কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলায় যুক্ত প্রায় সবাই সৌদি আরবের হওয়া সত্ত্বেও সৌদি আরবের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নিয়ে আফগানিস্তান ও ইরাককে কেন গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো, তা আগেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। ইরাক ও আফগানিস্তান দখলের পেছনে যে ইসরাইলের হাত ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ সন্দেহ খোদ মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের ভেতরেও বিদ্যমান। ইসরাইলের প্রত্যক্ষ মদদ ও মার্কিন করপোরেট শক্তিগুলোর প্ররোচনায় ইরাকে ‘ওয়েপন্স অফ মাস ডেস্ট্রাকশন’ ধ্বংসের নামে যে যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা অনেক সিনিয়র মার্কিন সেনা কর্মকর্তার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। অন্যের প্ররোচনায় এ ‘Pick and Choose’ নীতি অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্র যে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তা সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যের পছন্দ নয়। বিশেষ করে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কর্মকর্তারা এসব নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন। এমনই ক্ষোভ প্রকাশের একটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা আমার আছে। ২০১১-১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চপর্যায়ের এক প্রশিক্ষণ ক্লাসে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনার এক পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল পদবির একজন ইহুদি কর্মকর্তা ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অপর এক কর্মকর্তার সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির তীব্র সমালোচনা করে নানারকম তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্রের তক্ষুনি ইরানে আক্রমণ করা উচিত বলে মত প্রকাশ করেন।
ইহুদি কর্মকর্তাটির বক্তব্য শেষ হলে যুক্তরাষ্ট্রের একই পদবির অপর এক কর্মকর্তা আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন এবং ইহুদি কর্মকর্তার বক্তব্যের বিরোধিতা করে প্রশ্ন করেন, ‘‘তুমি ইরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড নিয়ে যে তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করলে; তোমার এ কথা কে বিশ্বাস করবে? তুমি তোমার এ বক্তব্য দিয়ে হয়তো বড়জোর আমেরিকান নাগরিকদের বোঝাতে পারো, কিন্তু আমেরিকাই একমাত্র দুনিয়া নয়। তুমি কি মনে করো, তোমার এ কথা (তথ্য) বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষদের তুমি বিশ্বাস করাতে পারবে? পারবে না! কারণ যে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা ইরাক ও আফগানিস্তানের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিলাম; যুদ্ধ শেষে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। তোমার মতোই তৎকালীন ফরেন সেক্রেটারি জেনারেল কলিন পাওয়েলও সেদিন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেনটেশন দিয়ে ইরাকে ‘ওয়েপন্স অফ মাস ডিস্ট্রাকশন’ মজুত আছে বলে সারা দুনিয়াকে ধোঁকা দিয়েছিলেন। আমাদের বলা হয়েছিল, ইরাকে তক্ষুনি আক্রমণ করা না হলে মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের কর্তৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যাবে। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। বুশ ও ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্তৃপক্ষের কথায় মটিভেটেড হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি।’’ কর্মকর্তাটি ক্ষোভমিশ্রিত কণ্ঠে আরও বলেন, ‘আমরা একটি মিথ্যাযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলাম। এ যুদ্ধে ইরাক ও আফগানিস্তানের লাখ লাখ মানুষ মারা গেছে।’ এরপর কর্মকর্তাটি আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে বলেন, ‘আফগানিস্তান দখলের পর আমি দু’বার সেখানে বদলি হয়ে গিয়েছি। প্রেসিডেন্ট বুশের এ মিথ্যাযুদ্ধের আমিও একজন ভিকটিম। আমি আমার সন্তানকে হারিয়েছি। আমার সংসার ভেঙে গেছে। দ্বিতীয় মেয়াদে আমি যখন আফগানিস্তানে ছিলাম, আমার স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা। আমাদের প্রথম সন্তান আসছে। স্ত্রীর পাশে তখন আমার থাকা জরুরি ছিল। কিন্তু আমি ছুটি পাইনি। আমি যখন কাবুলে অন্যায় একটি যুদ্ধে লিপ্ত, তখন নিউইয়র্কের এক ক্লিনিকে আমার স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতর। তার ওই প্রয়োজনীয় সময় স্বামী হয়ে কাছে থাকতে পারিনি। আমার স্ত্রী আমার অনুপস্থিতিতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত আমাদের একটি মৃত কন্যাসন্তান জন্ম হয়। এ দুঃসংবাদ যখন কাবুলে পৌঁছে তখন আমাকে ছুটি দেওয়া হয়। তাতে কোনো কাজ হয়নি। আমি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি পৌঁছানোর আগেই আমার স্ত্রী আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যান। এভাবেই আমি সন্তান ও সংসার হারাই।’ বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে তিনি ইহুদি কর্মকর্তাটিকে লক্ষ করে বলেন, ‘Bush is a liar. Don’t try to be smart again. Otherwise you will payback heavily.’
ওয়ার অন টেররের নামে যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া আফগান যুদ্ধে গত দুই দশকে সন্ত্রাস কতটুকু দমন হয়েছে সে প্রশ্ন কিন্তু রয়েই গেছে। বরং নিজেদের চোখে চিহ্নিত সন্ত্রাসী তালেবানদের বছরের পর বছর তাড়া করে আবার তাদের হাতেই আফগানিস্তানের দখলদারিত্ব ছেড়ে দিয়ে আফগানিস্তান ছাড়তে বাধ্য হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোনো অভিসন্ধি আছে কিনা এখনো তা স্পষ্ট নয়। দুই দশকব্যাপী ‘সন্ত্রাস দমন’ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ কোটি টাকারও বেশি। এর বেশিরভাগ অর্থই সামরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ব্যয় হয়েছে। সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের পুরো ঠিকাদারি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের বড় বড় অস্ত্র ব্যবসায়ীরা। ব্যয়বহুল এ যুদ্ধে আরও অর্থ ঢালতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত নয় বলে যে কথা বলা হচ্ছে, তা কতটুকু বিশ্বাসযাগ্য সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র যে কলেবরে তালেবানদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে এনেছে, তার পেছনের গোপন অভিসন্ধি হয়তো কিছুদিন বাদেই বোঝা যাবে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র জানে, তালেবান ক্ষমতাসীনরা বেশিদিন আফগানিস্তানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধরে রাখতে পারবে না। উচ্চপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের সদস্যদের চিন্তা-চেতনায় বিরাট ফারাক আছে। তালেবানের বর্তমান প্রশাসন দেশ পরিচালনায় যতই নমনীয় ভাব প্রকাশ করুক না কেন, বিশেষত নারী অধিকারসহ অন্যকিছু স্পর্শকাতর বিষয়ে যে ছাড়ের কথা তারা বলেছে, বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখছি না; বিশেষ করে তাদের নিম্নপর্যায়ের নেতাদের কট্টর মনোভাব তা বলে না। এখনই তাদের চিন্তা-চেতনায় যে দূরত্ব দেখা যাচ্ছে, দিন দিন তা আরও বাড়বে সন্দেহ নেই। যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে সে দুর্বলতাই কাজে লাগাবে। চীন-রাশিয়া তালেবানদের পাশে এসে দাঁড়ালেও যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বসে নেই। কারণ, তারা বিশ্বাস করে আফগানিস্তানের শান্তি কোনোদিনও ফিরে আসবে না। বরং তারা ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাই দেখছে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের কূটচাল ও নোংরা কূটনীতি আফগান পরিস্থিতিকে হয়তো সেদিকেই নিয়ে যাবে। ইসরাইল এবং তার গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ যে এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে তাতে সন্দেহ নেই।
নিবন্ধের প্রথমেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের ডিফেন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলিউশন কথা বলেছি। সে সময় শুরু করা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ সরঞ্জাম বিক্রির ধারাবাহিকতা এখনো ধরে রেখেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের যে বিপুল পরিমাণ ক্ষুদ্র ও ভারী অস্ত্রের ভাণ্ডার রিজার্ভ রাখা আছে, তার একটি নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল আছে। তারিখ পার হয়ে গেলে আমরা যেমন ওষুধ ফেলে দেই, ঠিক তেমনি আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে এলে এসব অস্ত্র ভাণ্ডারকে ফেজ আউট করতে হয়।
এতে প্রচুর অর্থের অপচয় হয়। যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এত বোকা নয়। কথিত আছে, বিশ্বের কোথাও না কোথাও যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এসব অস্ত্রশস্ত্র বিক্রির ব্যবস্থা করে। ঢাকঢোল পিটিয়ে তালেবানদের যেভাবে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা হলো, এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন, গোপন কী চুক্তি হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আফগানিস্তান যে আবারও যুদ্ধের ময়দানে (গৃহযুদ্ধে পরিণত হবে না, সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদি তাই হয়, তাহলে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসায়ীদের আফগানিস্তানে অস্ত্র বিক্রির পথটি কিন্তু খোলা রয়েই গেল। এসব বিবেচনা করে অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, তালেবানদের এই নব উত্থান যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবাণিজ্যেরই অংশবিশেষ।
একেএম শামসুদ্দিন : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা