শিরোনাম
২০১৮ সালে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ইমরান খান। তিনি হয়তো তখন ভাবেননি যে তার দলের নেতারা, যারা তাকে সমর্থন করেছেন তারাই একদিন বিরোধী দলকে সমর্থন দেবেন।
ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয় এবং সাড়ে তিন বছরেই তার সরকারের ইতি ঘটেছে। বহু নাটকীয়তার পর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারিয়েছেন ইমরান খান।
শনিবার সারাদিন জাতীয় পরিষদের অধিবেশন তিন চার দফা মুলতবি হওয়ার পর পাকিস্তানে মধ্যরাতের পর অনাস্থা ভোট অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম একজন প্রধানমন্ত্রীকে অনাস্থা ভোটে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হলো।
সাড়ে তিন বছরের শাসনে কতটা ব্যর্থ ও কতটা সফল হয়েছেন ইমরান খান তা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। ২০১৮ সালে নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী হওয়া পর ইমরান খান দুর্নীতি মোকাবিলা করা এবং অর্থনীতি ঠিক করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় পরিষদে তার প্রথম ভাষণে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ঘোষণা দেন যারা দেশের সম্পদ লুট করেছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। তবে যে প্রক্রিয়ায় এটি করা হয়েছিল সেটি ছিল বিতর্কিত এবং তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলেও মনে করা হচ্ছিল।
গ্রেফতার ও মামলার ধারা শুরু হলে বিরোধীরা পাল্টা অভিযোগ আনে। তবে সব মামলায় যৌক্তিক সমাধানও দেখা যায়নি। জবাবদিহি প্রক্রিয়ার ব্যর্থতার কথা স্বীকার করেছেন ইমরান খান নিজেও। তিনি বলেন, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আদালত আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে বিশ্লেষক মোশাররফ জাইদি বলেন, জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দেশের দুর্নীতি কমেনি।
অর্থনীতি ও মুদ্রাস্ফীতি
ইমরান খানের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেছিলেন যে, দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে, কারও কাছে সহায়তার জন্য যাবেন না, দেশের ঋণের বোঝা কমিয়ে আনবেন, মুদ্রাস্ফীতির অবসান ঘটবে। কিন্তু তার সেই দাবিগুলো স্বপ্নই রয়ে গেছে। ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন সরকার তাদের জনসমর্থন হারিয়েছে দেশের অভ্যন্তরে চড়া মূল্যস্ফীতি এবং ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক ঋণের বোঝা বাড়তে থাকার কারণে।
পাকিস্তানে রুপির দরপতন হয় ব্যাপক হারে। ফলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক দ্রুত বেড়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক আটলান্টিক কাউন্সিলের পাকিস্তান অংশের পরিচালক উজাইর ইউনিস বলেছেন, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ভারতে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ শতাংশ। সেখানে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ২৩ শতাংশ।
গ্যাস সংকট
পাকিস্তানে গ্যাস সংকটও অন্যতম একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কয়েক বছর ধরে স্থানীয় ভাবে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির উৎপাদন কমেছে। বৈশ্বিক ঘাটতির কারণে সম্প্রতি সেখানে এলএনজির দাম এমন পর্যায়ে গেছে যে, তা পাকিস্তানের পক্ষে বহন করা সম্ভব হচ্ছিল না। সাধারণ মানুষও গ্যাস নিয়ে চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে।
রাজনৈতিক ইস্যু
কিছু রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল ইমরান খান সরকারের বিরুদ্ধে। তার মন্ত্রিসভাকে অনেক বিশ্লেষকই দূর্বল বলে অভিহিত করেছেন। পাকিস্তানে এমন গুঞ্জন রয়েছে যে, ইমরান খান ক্ষমতায় আসতে পেরেছেন সেনাবাহিনীর মদতে। তাই রাজনৈতিকভাবে দূর্বল থাকায় মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রেও তাকে সমঝোতা করতে হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন। এছাড়া বিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ এবং পাঞ্জাবে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা ওসমান বাজদারকে মুখ্যমন্ত্রী করা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। পাকিস্তানের বিশ্লেষকরা বলছেন, পিটিআইএর মুখপাত্ররা ইমরান খানের দলের বা তার সরকারের কাজকর্ম তদারকির পরিবর্তে বিরোধী দলের কার্যক্রমে বেশি মনোযোগী ছিল।
বৈদেশিক নীতি
বৈদেশিক নীতিতেও ইমরান খান সরকারের ভুল ছিল বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। কখনও সৌদি আরব নারাজ আবার কখনও চীন নারাজ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ইমরান খান সরকারের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব
গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে ইমরান খান সরকারের বিরুদ্ধে। করাচির সেন্টার ফর এক্সিলেন্স ইন জার্নালিজমের পরিচালক আমবার শাসমি বলেন, আগের যে কোনো সরকারের চেয়ে গণমাধ্যমের প্রতি বেশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে ইমরান খান সরকার। গণমাধ্যমে বিরোধীদের বক্তব্য প্রচার বন্ধ, সাংবাদিক নির্যাতনসহ নানা ধরনের খবর তার সরকারের সময় সামনে এসেছে।
সফলতা ও প্রশংসামূলক কর্মকাণ্ড
ইমরান সরকারের নানা ধরনের ব্যর্থতা থাকলেও সফলতাও কম নয়। তার সরকারের সময় দেশে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে যা প্রশংসা কুড়িয়েছে।
কোভিড মহামারিতে ভিন্ন কৌশল
করোনা মহামারিতে যখন বিশ্বব্যাপী দীর্ঘ লকডাউন চলছিল পাকিস্তান তখন ভিন্ন চ্যালেঞ্জ নেয়। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে যেন না পড়তে হয় সেজন্য লকডাউন দীর্ঘ না করে আস্তে আস্তে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে বিভিন্ন সেক্টর খোলা রাখার কৌশল গ্রহণ করে পাকিস্তান। বিশ্লেষকদের মতে, এর ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতির সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো এড়ানো গেছে।
পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি
পাকিস্তানে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে রেকর্ড হারে। টেক্সটাইল খাতে মোট রপ্তানি বাড়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও এটি সহায়তা করেছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, টেক্সটাইল খাত চাঙ্গা রাখতে সরকার কম সুদে ঋণ দেওয়াসহ বিভিন্ন সুবিধা দিয়েছে। আর করোনাকালে অনেক বিদেশি ক্রেতাও পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকেছে।
হেলথ কার্ড
পাকিস্তানের মতো দেশে সাধারণ নাগরিককে হেলথ কার্ড দেওয়ার উদ্যোগ ইমরান খানের অন্যতম সফলতা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ইমরান খান এক প্রকল্পের আওতায় দেশের মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য হেলথ কার্ড দেওয়ার ঘোষণা দেন। এর মাধ্যমে জনসাধারণ সরকারি, বেসরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা সুবিধা পাবেন। এমনকি ব্রেন সার্জারি, ক্যান্সারসহ অন্যান্য রোগেও বিনামূল্যে চিকিৎসা পাবে সাধারণ জনগণ। সারাদেশের দেড় শতাধিক হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া যাবে এই হেলথ কার্ডের মাধ্যমে। তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, এই কার্ডের সুবিধার ফলে হাসপাতালগুলোতে চাপ বেড়েছে এবং এই কর্মসূচির জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন সেটাও ঠিকভাবে যোগান দেওয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে।
আবাসন
সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ইমরান খান। এই প্রকল্পের জন্য একটি নিউ পাকিস্তান হাউজিং অথরিটি গঠন করা হয় এবং প্রাথমিক পর্যায়ে সাতটি শহরে বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পের অধীনে সরকার সহজ শর্তে ব্যাংকগুলোকে ঋণ প্রদানের জন্য উৎসাহিত করেছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে ব্যাংকগুলো সাধারণ মানুষকে সেভাবে অর্থায়ণ করতে পারেনি।
বিলিয়ন ট্রি প্রজেক্ট
বিলিয়ন ট্রি প্রজেক্ট বা এক বিলিয়ন গাছ রোপন কর্মসূচি। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের সরকার ২০১৪ সালে এই কর্মসূচি শুরু করে। ইমরান খানের দল ওই প্রদেশে ক্ষমতায় এসে প্রায় তিন লাখ ৫০ হাজার হেক্টর বন ও অনুর্বর জমিতে একশ কোটি গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয় এবং এই কাজ আরও সম্প্রসারণের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই কর্মসূচি ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে।
তবে সফলতা বা ব্যর্থতা যাই থাকুক পাকিস্তানে দীর্ঘ ৭৫ বছরের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রী তার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ইমরান খানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তবে তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী যাকে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। পাকিস্তানের অর্থনীতির করুণ হালের কারণে হয়তো তার জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে কিন্তু তারপরেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইমরান খান এখনও এক পরাক্রমশালী রাজনৈতিক শক্তি বলেই মনে করা হয়।
সূত্র: বিবিসি