শিরোনাম
দীর্ঘ নাটকীয়তার পর পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটে হেরেছেন ইমরান খান। এর মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর পাশাপাশি পতন হয়েছে তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার খবরে বলা হচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা ও পাকিস্তান মুসলিম লিগের (নওয়াজ) সভাপতি শেহবাজ শরিফ।
অন্যদিকে, বাবা শেহবাজ শরিফ যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য লড়ছেন, তখন পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হতে আইনি লড়াইয়ে মেতেছেন ছেলে হামজা শাহবাজ। বাবা সুপ্রিম কোর্টে লড়ে এক লড়াইয়ে জিতেছেন। ছেলে লড়ছেন লাহোর হাইকোর্টে (এলএইচসি)। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতি এখন বাপ-ছেলের চমকের অপেক্ষায়।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি পাওয়া শেহবাজের প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য দেশের ভেতরে বেশ সুনাম ছিল। তিনি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই।
শেহবাজ শরিফ পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী পদে জাতীয় পরিষদে বিরোধীদলীয় জোটের প্রার্থী। শনিবার মধ্যরাতে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটির পর জাতীয় পরিষদে বক্তব্য দেন শাহবাজ।
এ সময় তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, ‘আমি অতীতের তিক্ততায় ফিরে যেতে চাই না। আমরা তাঁদের ভুলে যেতে চাই ও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চাই। আমরা প্রতিশোধ নেব না ও অবিচার করব না।’
৭০ বছর বয়সী শেহবাজের জন্ম লাহোরের ধনী ব্যবসায়ী পরিবারে। পড়াশোনা পাকিস্তানেই। পড়াশোনা শেষে পারিবারিক ব্যবসায়ে যোগ দেন তিনি। বর্তমানে পাকিস্তানের একটি ইস্পাত কারখানায় যৌথ মালিকানা রয়েছে তাঁর।
১৯৯৭ সালে পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে শেহবাজের রাজনৈতিক জীবন শুরু। ১৯৯৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে কারারুদ্ধ হন তিনি। পরের বছরেই সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানো হয় তাকে।
দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকার পর ২০০৭ সালে নিজ দেশে ফিরে আবার রাজনীতিতে পা রাখেন শেহবাজ। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জিতে ফের পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে তিনি তৃতীয় মেয়াদে প্রদেশটির মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
শেহবাজ জাতীয় রাজনীতিতে পা রাখেন তার ভাই নওয়াজ শরিফ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে পাকিস্তান ত্যাগের পর। এরপর তিনি পাকিস্তান মুসলিম লিগের (নওয়াজ) সভাপতির দায়িত্ব পান। শেহবাজের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতি মামলা হয়েছে। সেসব মামলায় তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি।
এদিকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্কের দিক দিয়ে শেহবাজ এগিয়ে। বিশ্লেষকদের ভাষ্য, শেহবাজের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। পারমাণবিক শক্তিধর এ দেশটিতে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত নীতিতে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর।
রাজনৈতিক অনেক বিশ্লেষকের মতে, শেহবাজ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলে তাকে খুব শিগগিরই একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। এর মধ্যে প্রথমেই রয়েছে চরম সংকটে থাকা পাকিস্তানের অর্থনীতি সামাল দেওয়া। বিরোধীরা ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার পেছনে একটি কারণ দেখিয়েছিল এই আর্থিক দুরবস্থাকেই।
এ ছাড়া শেহহবাজ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ, তাকে কাজ করতে হবে জোট সরকারের অন্য দলের দাবি ও মতামতকে সঙ্গে নিয়ে।
অন্যদিকে, গত ৮ এপ্রিল শুক্রবার এলএইচসির দ্বারস্থ হন শেহবাজের ছেলে পিএমএল-এন নেতা হামজা শাহবাজ। পাঞ্জাবের নতুন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন যেন ‘সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ’ হয়, সে জন্য আদালতের সাহায্য প্রার্থনা করেন তিনি। হামজার পিটিশনে বিবাদী করা হয়েছে পাঞ্জাব প্রদেশের চিফ সেক্রেটারি, পাঞ্জাব অ্যাসেম্বলির (পিএ) স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার এবং প্রাদেশিক পুলিশপ্রধানকে।
এলএইচসির প্রধান বিচারপতি আমির ভাট্টি পিটিশনটি গ্রহণ করেন। এর সঙ্গে একই রকমের আরেকটি পিটিশন গ্রহণ করেন তিনি। দ্বিতীয় আবেদনটি করেন পিএর ডেপুটি স্পিকার সরদার দোস্ত মাজারি। উল্লেখ্য, বিরোধী দলে যোগদানের জন্য সম্প্রতি তার ক্ষমতা কেড়ে নেন স্পিকার চৌধুরী পারভেজ এলাহি।
স্পিকারের আদেশকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না দাবি করে হামজার পিটিশন নিয়ে আপত্তি তোলেন রেজিস্ট্রার। কিন্তু এলএইচসির প্রধান বিচারপতি সে আপত্তিতে কান দেননি। শুনানির শুরুতে হামজার আইনজীবী সিনেটর আজম নাজির তারার বলেন, ৬ এপ্রিল প্রাদেশিক আইনপ্রণেতাদের অ্যাসেম্বলি ভবনে প্রবেশ করতে বাধা দেওয়া হয়। প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য ভোট অধিবেশন ৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পরে তা পিছিয়ে ১৬ এপ্রিল নিয়ে যাওয়া হয়।
বিচারক তখন কৌঁসুলিকে জিজ্ঞেস করেন, ‘ভোটের তারিখ যখন ঘোষণা করা হয়েছে, তখন সমস্যা কোথায়?’ আইনজীবী জবাব দেন, প্রদেশটি বেশ কয়েক দিন প্রধান নির্বাহীবিহীন থাকবে। একে তিনি ‘গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা’ বলে সতর্ক করেন। তিনি আরও জানান, পাঞ্জাবের অ্যাডভোকেট জেনারেল ৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে পরের দিন অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।
ডেপুটি স্পিকারকে এ বিষয়ে জানানো হলে তিনি অধিবেশন ডাকেন। গতকাল সুপ্রিম কোর্ট এক ‘ঐতিহাসিক’ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে বলেও মন্তব্য করেন এই আইনজীবী। এরপর এলএইচসির প্রধান বিচারপতি পাঞ্জাবের অ্যাডভোকেট জেনারেলকে তলব করেন এবং পিটিশনটি গ্রহণ করেন।
সূত্র: আল-জাজিরা ও দেশ রূপান্তর